‘সেহরির ওয়াক্তে পীরের রক্তে ভেসে যাওয়া জায়নামাজ’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সাধারণত দুই ধরনের চিত্র দেখি। একদলে দেখি অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা, আর অন্যদলে দেখি পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দেশীয় দোসরদের। কিন্তু এই সাদা-কালো ক্যানভাসের বাইরেও এমন কিছু ধূসর ও রক্তিম অধ্যায় আছে, যা সচরাচর আমাদের আলোচনার টেবিলে আসে না। একাত্তরে যখন ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালাচ্ছিল, যখন অনেক পীর-মাশায়েখ বা ধর্মভিত্তিক দল জান্তাদের ‘গনিমত’ সংগ্রহের ফতোয়া দিচ্ছিল, ঠিক ওই সময় বগুড়ার এক পীর পরিবার দেখিয়েছিল উল্টো স্রোতে হাঁটার বিরল সাহস। তারা প্রমাণ করেছিলেন, প্রকৃত ঈমানদারের রক্ত কখনোই জালিমের সঙ্গে আপস করতে পারে না।
বগুড়া শহর থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার উত্তরে, ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় ও বেহুলা-লখিন্দরের স্মৃতিবিজড়িত গোকুল ইউনিয়নের এক নিভৃত গ্রাম রামশহর। এই গ্রামেই অবস্থান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত পীর পরিবারের, যার গোড়াপত্তন করেছিলেন সুফি সাধক ডা. কহর উল্লাহ (রহ.)। আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি এতটাই সুপরিচিত ছিলেন যে, ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও বগুড়া আজীজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন নিয়মিত এই দরবারে আসতেন। জ্ঞানতাপস শহীদুল্লাহর পদধূলিধন্য এই বাড়িটি একাত্তরে হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের এক গোপন দুর্গ।
ডা. কহর উল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলেরা হাল ধরেন দরবারের। কিন্তু ১৯৭১ সাল যখন কড়া নাড়ল, তখন তারা তসবিহ হাতে কেবল খানকায় বসে থাকাকেই ধর্ম মনে করেননি তারা। পীর পরিবারের সন্তান হয়েও তারা বুঝেছিলেন, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করাও ইমানের অঙ্গ। পরিবারের চারজন সদস্য—শহীদ বেলায়েত হোসেনের ছেলে মাকসুদুর রহমান ঠান্ডু, ভাতিজা শহীদ আব্দুস সালাম লালু, জিল্লুর রহমান জলিল ও ভাগ্নে তোফাজ্জল হোসেন জিন্নাহ সরাসরি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। পীর বাড়ির ছেলেরা ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করছেন—এই খবরটি পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের জন্য হজম করা কঠিন ছিল। কারণ, তারা চেয়েছিল পীর-মাশায়েখদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। কিন্তু রামশহরের পীর পরিবার ওই ছকে পা দেয়নি।
১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর। রমজান মাস। গ্রামের আকাশ তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। চারদিক নিস্তব্ধ। রামশহর পীর বাড়িতে চলছে সেহরির প্রস্তুতি। পীর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা রোজা রাখার নিয়তে সেহরি খেতে বসেছেন। কারও খাওয়া শেষ, কেউবা শেষ নলাটি মুখে তুলছেন। পবিত্র রমজানের সেই শেষ রাতে বাড়ির বাতাস ছিল শান্ত, আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্যে পূর্ণ। কিন্তু তারা জানতেন না, ইবলিস তখন দ্বারে দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসে বুটের শব্দ আর চিৎকার। স্থানীয় রাজাকার মওলানা আবু তাহের ও ওসমান গনির নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা ঘিরে ফেলে পুরো পীর বাড়ি। তথাকথিত ‘ইসলামের হেফাজতকারী’ পাকিস্তানি বাহিনী পবিত্র রমজান মাসে, সেহরির ওয়াক্তে চড়াও হয় রোজাদারদের ওপর।
বাড়িতে ঢুকেই হায়েনারা চিৎকার করে খুঁজতে থাকে, “মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়? বন্দুক কোথায়?”
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যান সবাই। পীর সাহেবের ছোট ভাই মো. তবিবুর রহমান পরিস্থিতি বুঝে খাবার রেখেই প্রাচীর টপকে পালানোর চেষ্টা করেন। হানাদাররা তাকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি ছোড়ে। অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান এবং অন্ধকারের থাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনিই পরবর্তীকালে এই রোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হন।
কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যরা এত ভাগ্যবান ছিলেন না। পাকিস্তানি সেনারা পীর বাড়ির প্রতিটি ঘর তছনছ করে। একে একে ধরে আনে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের। বাদ যায়নি প্রতিবেশীরাও। পীর সাহেব শহীদ বেলায়েত হোসেন, তার ভাই দবির উদ্দীন, হাবিবুর রহমান এবং সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোর জাহিদুর রহমান মুকুলসহ মোট ১১ জনকে পিঠমোড়া করে বেঁধে উঠানে দাঁড় করানো হয়।
এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তখন। কিশোর মুকুল, যে হয়তো তখনো জীবনের মানেই ঠিকমতো বোঝেনি, সে তার মাকে বাঁচাতে ঘরের ভেতর থেকে একটি বন্দুক বের করে এনে মায়ের পেছনে দাঁড়াতে চেয়েছিল। মায়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে ছোট্ট শিশুর এই অসম সাহসী প্রচেষ্টাও নজর এড়ায়নি জল্লাদদের। কেড়ে নেওয়া হয় বন্দুক, তাকেও ঠেলে দেওয়া হয় মৃত্যুকূপের দিকে।
ততক্ষণে মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। “হাইয়্যা আলাল ফালাহ”—কল্যাণের দিকে এসো।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পীর বেলায়েত হোসেন হানাদারদের কাছে শেষ মিনতি করলেন, “আজান হয়েছে, আমাকে অন্তত দুই রাকাত ফজরের নামাজ পড়ার সুযোগ দাও। আমি আমার রবের পায়ে সিজদা দিয়ে মরতে চাই।”
কিন্তু যারা ধর্মের নামে মানুষ মারে, তাদের কাছে ধর্মের কোনো মূল্য নেই। পাকিস্তানি জল্লাদরা ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। যে বাহিনী নিজেদের ‘মুসলিম আর্মি’ বলে দাবি করত, তারা একজন রোজাদার পীরকে ফজরের নামাজটুকুও পড়তে দেয়নি।
আজান শেষ হওয়ার আগেই পীর বাড়ির পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় ১১ জন মানুষকে। ডা. কহর উল্লাহর তিন ছেলে—বেলায়েত, দবির ও হাবিবুর; নাতি সালাম, খলিলুর ও কিশোর মুকুল; এবং প্রতিবেশী আরও চারজন। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে ওঠে অটোমেটিক মেশিনগান। ব্রাশফায়ারের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে রামশহরের মাটি। সেহরির পবিত্র মুহূর্তে ১১টি তাজা প্রাণ লুটিয়ে পড়ে পুকুর পাড়ের মাটিতে। পুকুরের পানি আর ভোরের শিশিরভেজা ঘাস লাল হয়ে যায় শহীদের রক্তে। লাশগুলো ওভাবেই ফেলে রেখে উল্লাস করতে করতে চলে যায় হানাদাররা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণহত্যা
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ