ভারতে ইতিহাস মুছে ফেলার রাজনীতি: এবার টার্গেট তাজমহল
মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ সালে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন। স্কুলে আমার পাশে বসত আমার বন্ধু নারায়ণ। আমার মনে আছে ইতিহাস শিক্ষক এই বিষয়টা যখন পড়াচ্ছিলেন, নারায়ণ খুব মন খারাপ করেছিল।
ইতিহাসের ক্লাসে আমাদের আরেক দিন পড়ানো হলো পলাশীর যুদ্ধ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁর বিরাট বাহিনী নিয়েও হেরে গেলেন রবার্ট ক্লাইভের অল্প কয়জন সৈন্যের কাছে, অস্তমিত হলো বাংলার স্বধীনতা। এবার আমি ও নারায়ণ দুজনেই ক্লাসে খুব মন খারাপ করলাম।
ক্লাস থেকে বের হয়ে আবার আমরা স্বাভাবিকভাবে খেলাধুলা করলাম। কী আর আমরা করতে পারতাম? নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যেত না!
ইতিহাসের এসব দুঃখবোধ সবার থাকবে, যার যেমন আবেগ। কিন্তু ইতিহাসের ঘড়ি ও ঘটনা তো পাল্টানো যাবে না, সবাইকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হয়। পুরোনো ইতিহাসকে টেনে এনে নিজের মনে ও অন্যদের মনে জ্বালা সৃষ্টি করা কোনো কাজের কাজ নয়। আর সমাজে প্রতিহিংসা সৃষ্টি করা তো আরও জঘন্য কাজ।
ঠিক এই জিনিসটাই হচ্ছে আজকের ভারতে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন নিয়ে কিছু লোক এমনিতেই অন্তর্জ্বালায় ভুগছেন, নরেন্দ্র মোদির উত্থানের পর তাঁরা ক্রমান্বয়ে প্রতিহিংসার বারুদ ছড়াচ্ছেন। এই প্রতিহিংসা ভারতের হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে মিশে ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করছে। ইতিহাসের প্রতিহিংসার প্রথম বড় বলি ছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদ, যেটাকে ভেঙে গড়া হলো রামমন্দির।
ভারতের অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী জনগণ অবশ্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কার্যক্রমকে নিন্দা জানিয়ে আসছে। এমনকি গত সাধারণ নির্বাচনে রামমন্দির এলাকার সংখ্যাগুরু হিন্দু জনগণ ভোট দিয়ে বিজেপির লোকসভা প্রার্থীকে হারিয়ে জানান দেন—তারা এসব উগ্রতার বিরুদ্ধে।
তাই বলে কি উগ্রবাদীদের দমানো যায়? তাঁরা মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াবার জন্য নতুন নতুন কৌশল বের করা শুরু করলেন।
এইসব ‘সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদেরা’, কেউ কেউ ‘স্থপতিবিদ’ সেজে মোগল স্থাপত্যের সমালোচনা করছেন। আবার কেউবা ‘প্রত্নতাত্ত্বিক’ সেজে কোন মসজিদের নিচে কয়টা মন্দির আছে এবং তাজমহল কোন মন্দির দখল করে গড়া হয়েছে, এসব নিয়ে ‘ইতিহাস’ গড়ছেন। এই উগ্রবাদীরা রাজনৈতিক কারণে ইতিহাসকে টেনেহিঁচড়ে অপ-ইতিহাস তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন এবং সমাজে ধর্মীয় বিভাজন ছড়াচ্ছেন।
তাঁরা এসব অপ-ইতিহাস প্রচার করতে বিভিন্ন উপায় বের করছেন এবং আরও বেশি লোককে ক্রুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে এই ইতিহাসের বিকৃতি আরও বড় আকারে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দক্ষিণপন্থী চিত্র প্রযোজক-পরিচালক ও সিনেমাকর্মীদের একটা গ্রুপ ইতিহাসকে বিকৃত করে নতুন নতুন চলচ্চিত্র তৈরি করছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের ও পরেশ রাওয়ালের মতো নামকরা অভিনেতারা।
২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’, যাতে অভিনয় করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী ও অনুপম খের; এই ছবিতে দেখানো হয়েছে কাশ্মীর সমস্যার মূল ভিত্তি হলো মুসলমানদের হাতে হিন্দুদের নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা। এটা ছিল একটা মিথ্যাচার প্রচারমূলক ছবি, যা কাশ্মীরের আলাদা রাজ্যের মর্যাদা হরণে মোদির চক্রান্তের একটা সাফাই ছিল। এই ছবির সাফল্যের কারণ বলা যায়, বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোতে এর টিকিট করমুক্ত ছিল এবং এটা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল।
এর আগে ২০১৮ সালে নির্মিত হয়েছিল ‘পদ্মাবত’ সিনেমা। রাজকুমারী পদ্মাবতী এবং আলাউদ্দিন খিলজিকে নিয়ে সিনেমা। পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালি। এই ছবি নিয়ে বানসালিকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। অনেক জায়গায় এই সিনেমার শুটিংয়ে বাধা দেওয়া হয়, সেট পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বানসালি একজন উদারপন্থী সৃজনশীল পরিচালক, কিন্তু ডানপন্থী ও সেন্সর বোর্ডের চাপে তাঁকে ছবির স্ক্রিপ্টে অনেক পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
এবার কল্পকাহিনির ভিত্তিতে সিনেমা বানানো হয়েছে তাজমহলকে নিয়ে, নাম—‘দ্য তাজ স্টোরি’। ‘দ্য তাজ স্টোরি’তে তাজমহলের পেছনের ‘সত্য’ উন্মোচনের দাবি করা হয়েছে। ছবিটিতে বলা হয়েছে, মোগল সম্রাট শাহজাহান ‘দখল’ করার আগে, স্মৃতিস্তম্ভটি একসময় ‘তেজো মহালয়া’ নামে একটি হিন্দু মন্দির ছিল। এই কল্পকাহিনি বহু বছর ধরে নানাভাবে হিন্দু উগ্রবাদীরা প্রচার করে আসছিল, খুব কম লোকই এটাকে বিশ্বাসে স্থান দিয়েছিল। এখন ছবি করে এই কল্পকথা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এতে অভিনয়ে যোগ দিয়েছেন খ্যাতনামা ভারতীয় অভিনেতা পরেশ রাওয়াল ।
ছবিটি সম্প্রীতি মুক্তি পেয়েছ। ছবিটি নিয়ে এর মধ্যে ভারত ও ভারতের বাইরে দারুণ হইচই হচ্ছে। কারণ, তাজমহল পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি, ভারতের সবচেয়ে স্বীকৃত স্মৃতিস্তম্ভ, ভারতের পর্যটন দপ্তরের ইশতেহারের প্রথম পাতায় থাকে এর ছবি এবং এটা ইউনেসকোর একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম কড়া ভাষায় এই সিনেমা নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।