অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই যে খাতটিতে সংস্কার আনতে পারত, তার মধ্যে এগিয়ে থাকবে সড়ক পরিবহন। জুলাই অভ্যুত্থান যে ছাত্রদের হাত ধরে সূচনা হয়েছিল এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যাঁরা ধাপে ধাপে গণ–অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশ ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে মার খাওয়া প্রজন্ম। ঢাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে একাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেটা ছিল নজিরবিহীন। ২০১৮ সালে সত্যি সত্যি এ দেশের বুকে আঠারো নেমে এসেছিল।
কিন্তু শিশু-কিশোরদের সেই আন্দোলনকে ছাত্রলীগ, যুবলীগের পেটোয়া হেলমেট বাহিনী আর পুলিশ দিয়ে যেভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে দমন করেছিল হাসিনা সরকার, সেটাও ছিল নজিরবিহীন। সেটা ছিল নিজ দেশের শিশু–কিশোরদের বিরুদ্ধে দমনে শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রের যথেচ্ছ বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত। ঠিক ছয় বছর পর ২০২৪ সালে এসে সব শ্রেণির জনতার অংশগ্রহণে রাষ্ট্রের সেই শক্তিশালী দামনযন্ত্রটিকে রুখে দিয়ে ইতিহাসের চাকাটি পাল্টে দিয়েছিল সেদিনের সেই কিশোর থেকে সদ্য তরুণ হয়ে ওঠা প্রজন্মটি।
আওয়ামী লীগ সরকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজ করেনি। তার কারণ পুরোপুরি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি তারা গড়ে তুলেছিল, তার প্রধান একটা জায়গা ছিল যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। বাজেটে এ খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে, একের পর এক মেগা প্রকল্প হয়েছে। তাতে ক্ষমতার একেবারে প্রথম বৃত্তে থাকা লোকদের সম্পদ বেড়েছে আলাদিনের চেরাগের মতো। সেই সম্পদের একটা বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।
এ বাস্তবতার বিপরীতে চরম দুর্নীতিনির্ভর পরিবহন খাত বর্গা দেওয়া হয়েছে দলীয় মাফিয়া ও মাস্তানদের হাতে। বলা চলে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল এ খাতেই। ফলে সড়কে নৈরাজ্য আর অরাজকতার যে বিষচক্র তৈরি হয়েছে, তার নিষ্ঠুর বলি হতে হয়েছে নাগরিকদের।
ফলে সবাই আশা করেছিলেন, অভ্যুত্থানের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। ঢাকার মানুষেরা একটা সুশৃঙ্খল বাসব্যবস্থা পাবে। অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক দিন যখন পুলিশ ছিল না, তখন ছাত্ররাই ঢাকার সড়কগুলোতে শৃঙ্খলার নজির তৈরি করেছিলেন। বাসসহ অন্য যানবাহগুলো লেন মেনে চলাচল করতে শুরু করেছিল। সবার মধ্যেই আইন মানার একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি শিক্ষার মতো পরিবহন খাত সংস্কারে সরকারের উদ্যোগ নিতে অনীহা দেখা গেল।
এ সুযোগে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় সুনামির মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যুক্ত হলো। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে গত এক বছরে কর্মসংস্থানে যে ভাটার টান, নিঃসন্দেহে সেই বাস্তবতা পরিস্থিতিকে উসকে দিয়েছে। কিন্তু সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যায়, এমন কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণে এমন বিশৃঙ্খলার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।
সব মিলিয়ে ঢাকার সড়ক গত এক বছরে আরও বেশি নৈরাজ্যিক আর বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। সারা দেশে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে ওঠায় হতাহতের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। ঢাকার সড়কগুলো দাবড়ে বেড়াচ্ছে, সেই একই রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড় বাস, নোংরা সিট ও শ্বাস বন্ধ করে দেওয় কালো ধোঁয়া আর কানে তালা লাগা হাইড্রোলিক হর্ন। রেষারেষি, দুর্ঘটনা, যাত্রীদের সঙ্গে বচসা, মারামারি—পুরোনো সেই সবই চলছে দিব্যি।
ট্রাফিক পুলিশের অবর্তমানে শিক্ষার্থীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সড়কে শৃঙ্খলার কাজে নেমেছিলেন, তখন ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ও আইন মেনে চলার একটা চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের সময়ও শিশু-কিশোরেরা সৃজনশীল সব পথ বের করে দেখিয়ে দিয়েছিল, সড়কে কীভাবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়, আর আইন যিনিই ভঙ্গ করেন, তাঁকে কীভাবে জবাবদিহি করা যায়। কিন্তু ছাত্রদের আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাফিক সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর বেশি দিন চোখে পড়েনি। বরং তাঁদের পুরোনো ট্রাফিক ব্যবস্থার অংশ করে তোলা হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সড়কে শৃঙ্খলা