
আউটসোর্সিং, তুঘলকি নিয়োগ–বাণিজ্য ও সংস্কারের জাতপাত
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় দেখছি আন্দোলন করতে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আন্দোলন করেছে ‘আউটসোর্সিং’ নামের এক নিয়োগপদ্ধতির বিরুদ্ধে। কারা আন্দোলন করছেন, কেন করছে, বুঝে উঠতে সময় লাগে। আউটসোর্সিং কি খারাপ? এই লোকগুলো কারা, কী চান? তাঁরা কি সরকারি চাকরিতে স্থায়ী হতে চান? রাজস্বকরণ মানে কী?
প্রথমেই মনে হবে, সরকার আর কত চাকরি দেবে? হাসিনা লুটেপুটে নিয়ে গেছে রাজকোষ, এত এত দাবিদাওয়া—একদিকে তথ্য আপারা দুই মাস ধরে বসে আছেন প্রেসক্লাবের সামনে, আরেক দিকে সচিবালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও আন্দোলন করছেন, সবাই চাকরি স্থায়ী করতে চান, রাজস্বকরণ চান, সরকার কি মামাবাড়ি!
জুলাই ও সরকারি চাকরি
সরকার ব্যস্ত জুলাই নিয়ে। জুলাইয়ের তোরণ, জুলাইয়ের ড্রোন, জুলাইয়ের আর্ট কালচার, জুলাইয়ের চেতনা—এত বড় সব প্রজেক্ট চলছে, সংস্কার চলছে, এর মধ্যে সরকারি চাকরি নিয়ে এসব অগুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির লোকজনের আহাজারি-আন্দোলন কিছুটা বিরক্তিকরই!
আচ্ছা, জুলাই অভ্যুত্থানের শুরুটা যেন কী নিয়ে ছিল? কারা কিসের উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন? সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বৈষম্য নিয়ে কারা যেন মাটি কামড়ে আন্দোলন করছিলেন? আওয়ামী লীগ বলল, এরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারের সন্তান, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর বিসিএস প্রজন্ম, খালি সরকারি চাকরি চায়।
আমরা বললাম, দেশে কর্মসংস্থান নেই, বিনিয়োগ নেই, ৮৬ ভাগ মানুষ ইনফরমাল খাতে কাজ করে, ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভঙ্গুর, ২ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান কমছে, লাখ লাখ সার্টিফিকেটধারী তরুণ বেকার বসে আছেন; বাংলাদেশের ‘জবলেস গ্রোথ’ বাস্তবতায় সরকারি চাকরি ‘ক্রেইজ’ নয়; বরং সরকারি চাকরির জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
এখন যেহেতু অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিপ্লবী চেতনা বাস্তবায়ন চলছে, বিরাট বিরাট সংস্কার চলছে, তাহলে এখন সরকারি চাকরিতে বৈষম্য আর নিয়োগ–বাণিজ্যের আলাপটা স্রেফ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল কেন? ছাত্রদের সরকারি চাকরির আন্দোলন ঐতিহাসিক ঘটনা আর ‘চতুর্থ শ্রেণির ছোট ছোট’ লোকদের চাকরি বাঁচানোর আন্দোলন আজাইরা?
‘আউটসোর্সিং’ নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতির অবাধ সুযোগ
সরকারি হাসপাতাল, সরকারি ব্যাংক, ঢাকা ওয়াসা, পল্লী বিদ্যুৎ বা ডেসকোর মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঠিকাদারি কোম্পানির মাধ্যমে সরকারি নিয়োগের এই চর্চা শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে ব্যয়ভার ও ঝামেলা কমানোর নামে। ব্যয়ভার তো কমেইনি; বরং নিম্ন আয়ের মানুষকে চাকরি দেওয়ার নামে শুরু হলো শতকোটি টাকার এক ভয়াবহ নিয়োগ–বাণিজ্য। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটু কথা বললেই খোঁজ মিলবে এক তুঘলকি কাণ্ডের।
সরকারের এই কাজগুলো মূলত স্থায়ী কাজ, অথচ নিয়োগ হয় ঠিকাদারের খেয়ালখুশি তো। চুক্তিপত্রে লেখা থাকে ১৫ হাজার টাকা আর কর্মচারী বেতন পান ৮ হাজার টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ নেওয়া হয় ৩০০ কর্মীর, অথচ নিয়োগ পান ২০০ জন। সেই ২০০ জনকে দিয়ে আবার ৩০০ জনের কাজ করানো হয় আর বাকিদের বেতন কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায় (দেখুন, ‘আউটসোর্সিং-কর্মীদের বেতনে পেট ভরছে ঠিকাদারের’, যুগান্তর, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫)।
সব মিলিয়ে একদিকে পাবলিকের টাকা লুট, আরেক দিকে শ্রম আইনের কী মারাত্মক লঙ্ঘন! যেহেতু ঠিকাদারি বন্দোবস্ত, তাই সরকারের কোনো দায় নেই। বর্তমানে এই মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়েছেন দেশের প্রায় সাত লাখ সরকারি কর্মচারী।
একটি সরকারি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী লাগবেই, ওয়ার্ডবয় লাগবেই, আয়া লাগবেই। সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা প্রহরী লাগবেই। পল্লী বিদ্যুতে লাইনম্যান লাগবেই। ডেসকো, ডিপিডিসিতে মিটার রিডার লাগবেই। ঢাকা ওয়াসায় পাম্প অপারেটর লাগবেই।
এগুলো সরকারের স্থায়ী এবং চলমান কার্যক্রম। শুরুতে ‘অ্যাডহক’ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু একদল কর্মী চার-পাঁচ বছর ধরে ঝাড়ু দেবেন, পাহারা দেবেন, পাম্প চালাবেন, ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি মেরামত করবেন, রোগীর পায়খানা সাফ করবেন, অথচ কয়েক বছর পরপর পুরোনো গার্ড, পুরোনো লাইনম্যান, পুরোনো ক্লিনার, পুরোনো আয়া-বুয়াকে স্রেফ ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হবে, এর মানে কী?