
ইসরায়েলের ভেতরে যে প্রতিরোধের কথা আমরা জানি না
ইসরায়েল—একটি রাষ্ট্র, যার নাম উচ্চারণেই ভেসে আসে ফিলিস্তিনের ওপর দখল, বোমাবর্ষণ আর নির্মম হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। কিন্তু এই দখলদার রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যুদ্ধ, বর্ণবাদ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। তারা কারা? তাদের কথা আমরা খুব বেশি শুনতে পাই না কেন? তারা কি নিছক কিছু নিঃসঙ্গ বিবেকবান ব্যক্তি, নাকি মানবতার পক্ষের কোনো সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক?
ইসরায়েলে বর্ণবাদবিরোধিতার আদি মুখ: মেইর ভিলনার
ইসরায়েলের ইতিহাসে যুদ্ধ ও নিপীড়নের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া মানুষের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। এর শুরুর দিকেই রয়েছেন মেইর ভিলনার (১৯১৮-২০০৩) একজন মার্ক্সবাদী, যিনি ইসরায়েলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় একজন স্বাক্ষরকারী হয়েও জায়নিজমের সমালোচক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে ইহুদি জনগণ আত্মরক্ষা করতে পারে ঠিকই, তবে সেই রাষ্ট্র যেন বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক না হয়। তিনি ছিলেন দুই জাতির (ইহুদি ও আরব) সমান অধিকারের পক্ষে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার রক্ষার সোচ্চার সমর্থক।
ভিলনার ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টি ‘মাকি’র নেতা হিসেবে দীর্ঘকাল পার্লামেন্টে বামপন্থী-বিরোধী কণ্ঠ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে যখন ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা ও গোলান মালভূমি দখল করে, তখন তিনি তা ‘আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়ে সংসদে প্রতিবাদ করেন। এই অবস্থানের জন্য তিনি ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত হন। একবার এক কট্টর ইহুদির হাতে ছুরির আঘাত খেয়েও বেঁচে যান।
ভিলনারের উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে ওঠে হাদাশ নামে আরব-ইহুদি বামপন্থী রাজনৈতিক দল, যা এখনো ইসরায়েলি সংসদে সক্রিয়। তারা তাঁকে নিজেদের আদর্শিক পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করে।
ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠ
ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে ‘মাপাম’, ‘মাকি’ বা ‘হাশোমের হাতসায়ার’-এর মতো বামপন্থী সংগঠনগুলো আরব-ইহুদি সহাবস্থানের পক্ষে ছিল। তারা মনে করত, ইহুদি নিরাপত্তা অর্জনের জন্য আরবদের জমি দখল বা বিতাড়ন কোনো টেকসই সমাধান নয়। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও গাজার দখলের পর ‘অধিকৃত ভূখণ্ড’ শব্দটি ইসরায়েলি মানবাধিকারকর্মীদের মাধ্যমেই প্রথম ব্যবহার শুরু হয়।
এই ভিন্নমতের ধারাকে এখনো জীবিত রাখছে এক ঝাঁক সংগঠন: যেমন ‘বেতসেলেম’, ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’, ‘যেশ গ্ভুল’, ‘মখসোম ওয়াচ’, ‘আনরিপোর্টেড ইন ইসরায়েল’, ‘জোচরট’। এসব দলে রয়েছেন সাবেক সেনা, নারী অধিকারকর্মী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকেরা। তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য—ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে, তা যুদ্ধাপরাধ।
যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠকে চেপে ধরার সংস্কৃতি
এই মানবিক কণ্ঠগুলোকে বরাবরই দমন করেছে ইসরায়েলি রাষ্ট্র। কখনো ‘স্বজাতি-বিরোধী’ আবার কখনো ‘হামাসপন্থী’ বলে তাঁদের হেয় করা হয়। গবেষণায় অনুদান বন্ধ হয়ে যায়, চাকরি চলে যায়, বিদেশে পালিয়ে যেতে হয়। যেমন ২০০৮ সালের গাজা যুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভেতরের নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু সাবেক সেনাসদস্য গঠন করেন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’। সরকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেনি ঠিকই, কিন্তু তাঁদের ওপর চলছে লাগাতার নজরদারি, হুমকি আর আর্থিক নিপীড়ন।
২০১৮ সালে ‘নেশন স্টেট ল’ পাস করে ইসরায়েল। এতে বলা হয়, শুধু ইহুদিরাই রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র। এই আইনের বিরুদ্ধে সংসদে মুখ খুলেছিলেন হাদাশ পার্টির আইমান ওদে, ইহুদি বামপন্থী দোভ খানিন এবং নারী আইনপ্রণেতা তামার জানবার্গ। তাঁদের ভাষায়, এই আইন গণতন্ত্রের মুখোশ পরে জাতিগত আধিপত্য কায়েম করে।