
‘আম কুড়াতে সুখ’ তবু কেন কৃষকের শোক
পুকুর পাড়ে কিংবা ঘরের পেছনে দু-চারটা আমগাছ। টিনের চালে টুপটাপ দু-একটা আম পড়ার শব্দ। শিশুদের ঝড়ের বেগে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু-আম কুড়ানোর লক্ষ্যে। সবার স্মৃতিতেই থাকার কথা এমন শৈশবের কথা। বোধকরি, কবি জসীম উদদীন ‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ’ লিখেছিলেন সেই স্মৃতিতেই। সুখের এই স্মৃতির মধ্যেও ইঙ্গিত আছে-আমের প্রাচুর্য ছিল না আজকের মতো।
মাত্র বছর কুড়ি আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান হবে পৃথিবীর মধ্যে নবম। কেউ ভাবতে পারেনি, বাংলাদেশ আম রফতানিকারক দেশের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করতে পারবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন আম রফতানিকারক দেশ। পৃথিবীর ২৮টি দেশে এখন বাংলাদেশের আম রফতানি হয়। অন্য আরেকটি তথ্য আছে ৩৪টি দেশে আম রফতানির কথা। আর এপথে যাত্রাটাও খুব বেশিদিন আগের নয়, ২০১৫ সালে প্রথম আম রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। এত দ্রুত আম উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে যে ইংল্যান্ড, জাপান, ইউরোপের বেশ কিছু দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানি করতে উৎসাহ প্রকাশ করেছে।
একসময় ঢাকার বাজারে দেশি টক-মিষ্টি আম ও মৌসুমের শেষ দিকে ফজলি আমের দেখা মিলত। টক-মিষ্টি আমের ভেতর থাকতো পোকা। কোনোটা আবার এত টক হতো যে মুখে দেওয়া যেতো না। কিন্তু মৌসুমি ফল এবং রসের কারণেই আম ফলটি কবিদেরও দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিল। বাজারে চাহিদা ছিল অনেক, সরবরাহ ছিল কম। যে কারণে এখনকার তুলনায় তখন আমের দাম ছিল বেশি।
আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের (আম ) মেধা ও শ্রম এবং আম চাষীদের অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলাদেশকে আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আজ বাংলাদেশে উৎপাদিত আম অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম শুধু তাই নয়, রফতানিও করতে পারছে। ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের এই যাত্রায় এখন ২৭ লাখ মেট্রিক টনে গিয়ে পৌঁছেছে। চাষ হচ্ছে ২৭ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে। বিজ্ঞানীদের সাফল্য দৃশ্যমান। একের পর এক জাতের আম বাজারে আসছে তাদেরই কল্যাণে। ফলনও বেড়েছে একই কারণে। কিন্তু ফলন বৃদ্ধির পরও চাষির মুখে যতটা হাসি ফোটার কথা ছিল সেই হাসি নেই। বাজারে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষক কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হয়নি এখনো। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী রফতানি করা আমের গুণগত বিশ্বমানের না হওয়ায় বাংলাদেশের আমের প্রতি বিদেশিদের আকর্ষণ কম হচ্ছে। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হচ্ছে স্থানীয় কৃষক ও সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই প্রধান কারণ। সরকারি কর্তৃপক্ষ উৎপাদন বৃদ্ধিতে যতটা বেশি নজর দেয় গুণগত মান বৃদ্ধি, বাজারজাতকরণে ততটাই উদাসীন বলে মনে করা হয়। নতুন নতুন জাতের আম উৎপাদন ও উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজারজাতকরণ, গুণগত মান বৃদ্ধি, উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও বাজারজাতকরণে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। বিদেশিদের চাহিদা নিরূপণ ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দিকেও নজর দিতে হবে।
এবছর আমের ফলন গত বছরের চেয়ে ভালো। এবং দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম। আগে উৎপাদন কেন্দ্রের কাছাকাছি আড়তগুলোতে যেখানে মৌসুমের শুরুতে আম বিক্রি হতো ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে এবার নেমে ৩০-৪০টাকায় পৌঁছেছে। এই আম বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়তো দাম হয়ে যায় ৮০-১০০টাকা কেজি। এতে ভোক্তারা খুশি হলেও উৎপাদনকারীদের লোকসান গুনতে হয়। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আম উৎপাদন করে কিন্তু তার আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং বাজারজাতকরণের ধারণা কম। সেটা স্বাভাবিকও। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার বিষয়টি তৃণমূলের কৃষকদের অজানা থেকে যায়।