
অভিবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা আমরা কতটা জানি?
মাঝে মাঝে অভিবাসী শ্রমিকরা আলোচনায় আসে। কখনো সেমিনারে, কখনো সরকারি সভায়, কখনো ঘরে-বাইরে চায়ের আড্ডায়। আলোচনায় আসে যখন সরকার বা গবেষকের হিসাব করতে হয় দেশের কোষাগারে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত আছে বা দেশের অর্থনীতির হালচাল কী।
এই আলোচনায় বিদেশে খেটে খাওয়া নারী পুরুষকে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে সম্মানিত ও সম্বোধন করা হয়। আমি, আপনি বিদেশ ভ্রমণের সময় আমাদের পাশের ইমিগ্রেশনের সারিতে বা বিমানে আমাদের পাশের সিটেই খুব কাছে থেকে এই শ্রমিক ভাইবোনদের দেখি।
এ সবকিছুর আড়ালে থেকে যায় প্রবাসে এই মানুষগুলোর শ্রমের সংগ্রাম, জীবনের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম কখনো তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটায়, কখনো চোখ থেকে অশ্রু ঝরায়। এমনই অশ্রু ঝরানোর একটি কারণ অকালে হারানো প্রবাসী অভিবাসী শ্রমিকের প্রাণ। জন্মমৃত্যুর আবর্তে মানুষ, তথা সব প্রাণের জন্য মৃত্যু অবধারিত প্রাকৃতিক নিয়ম।
তবে তা যদি স্বাভাবিকতার বাইরে হয়, তা হয় অনেক মাত্রায় বেশি মর্মান্তিক। বিভিন্ন সময় অভিবাসীদের মৃত্যুর বিবরণ ও পরিসংখ্যান, গবেষণা, প্রতিবেদন এবং নানা পর্যায়ের আলোচনায় আসে, আবার হারিয়ে যায়। মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো তরুণ বয়সে আপাত শক্ত-সমর্থ মানুষ প্রাণ হারান—কখনো দুর্ঘটনায়, কখনো অজ্ঞাত কারণে।
সাম্প্রতিক একটি সংবাদ প্রতিবেদনে সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে, ১৯৯৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৭,২১৬ জন বাংলাদেশির মরদেহ প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত আনা হয়েছে। এদের মধ্যে ২০২৪ সালে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৪,৮১৩ জনের মরদেহ।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ করেছে যে আগের বছরের চেয়ে ২০২৪ এশিয়ার অভিবাসীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এমনকি নাম না জানা নিখোঁজ অভিবাসন কর্মীদের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টায় সাগরে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যেও বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর হয়ে পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশে যাওয়ার পথেও কিছু বাংলাদেশের মৃত্যু হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে সব তথ্য সন্নিবেশিত নেই, তাই যেটুকু জানা যায় তার চেয়ে মৃত্যুচিত্র আরও ভয়াবহ বলেই ধারণা করা যায়।
আমাদের অভিবাসীদের এই মর্মান্তিক পরিণতি কোনো মানুষই চায় না। অভিবাসী প্রত্যাশীরা নিজেরাও চান না। তারা নিজেরা এবং তাদের পরিবার একটু ভালো থাকার আশায় বিদেশে যান বা যাওয়ার চেষ্টা করেন। বেশিরভাগই পুরুষ।
বেশিরভাগই তরুণ, কেউ কেউ বিবাহিত। নিজের ও সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে। অনেকেই দরিদ্র, অনেক কষ্ট করে বিদেশ যাওয়ার অর্থের ব্যবস্থা করতে হয়। কাজেই এতকিছুর মধ্যে মৃত্যুভয় বা মৃত্যু চিন্তা কোনটাই থাকে না। তবে অনেক সময় যেই ঝুঁকি তারা নিয়ে থাকেন তা যে জীবনের কতটা ঝুঁকি, এটা তারা পরিমাপ করতে পারেন না বা করতে চান না। তবে সচেতন এবং নীতি নির্ধারণ-বাস্তবায়ন মহলের চেষ্টা থাকা উচিত এই মৃত্যু রোধ করার উপায়।
ভাবা ও জানা দরকার, মধ্যপ্রাচ্যে তরুণ শ্রমিক ভাইদের মৃত্যুর কারণ ও তা রোধ করার উপায় কী। সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, এদের অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। কেউ কেউ দুর্ঘটনায় বা বিশাদগ্রস্ততা থেকে মারা যেতে পারেন, কিন্তু বেশিরভাগেরই মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক