দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের হাল ধরেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মূলত এর পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে একধরনের শীতলতা সৃষ্টি হয়েছে। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত এই দুটি দেশের সম্পর্কে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
এই সম্পর্কের অবনতির পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগে ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধাও প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বন্দরগুলোতে কনটেইনারজটের কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এর পেছনে রয়েছে ‘অন্য’ কারণ। মূলত ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফর এবং সেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য (সেভেন সিস্টার্স) নিয়ে করা মন্তব্য ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ড. ইউনূস ওই অঞ্চলে সমুদ্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘অভিভাবক’-এর ভূমিকা পালনের কথা বলেছিলেন, যা ভারত ভালোভাবে নেয়নি। ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের পরই ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা এবং ভারতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয়ও দুই দেশের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ব্যাংককের বৈঠকেও মোদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির নানা তৎপরতা। ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলো দাবি করছে, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তানের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে, যা ভারতীয় সীমান্তের কাছে হওয়ায় দিল্লির নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘ ১৫ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফর এবং খুব শিগগির দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের কর্মসূচিও বিশ্লেষকদের নজর এড়ায়নি। তিস্তা প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকেও ভারত ভালোভাবে দেখছে না।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে? ড. ইউনূস অবশ্য বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সম্পর্কের অবনতির কথা অস্বীকার করেছেন এবং এটিকে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ ও ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ভারতের কূটনীতিকেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের কারও কারও মতে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকার কারণে তাঁর বিদায়ের পর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান ইউনূস প্রশাসন ভারতের প্রতি ‘বিশেষ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব’ দেখাচ্ছে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ‘অস্বাভাবিক’। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং এই মুহূর্তে এই মনোভাব পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে এই সম্পর্কের অবনতি কি ভারতের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ? ভারতীয় কূটনীতিকেরা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, দীর্ঘদিনের লালিত সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কের এই পরিবর্তন অবশ্যই ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনার আমলে দুই দেশের মধ্যে সংযোগ, বাণিজ্য, কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হচ্ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা থমকে যেতে পারে। সবকিছু এখন নেতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ।
শুধু ভারত নয়, দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও অনুকূল নয়। কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় বিরোধের উৎস এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। সংকটগুলোর মূলে রয়েছে পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু, বিশেষত তিস্তা ও ফারাক্কার পানি বণ্টন। এটিকে কেবল উৎস ও নিম্নধারার পানিপ্রবাহের গতানুগতিক বিরোধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে, এর আঞ্চলিক ও স্থানীয় প্রভাব অনেক গভীর। বাণিজ্যিক বিষয়ে ভারসাম্যহীনতা এবং কোনো একটি দেশের ওপর অন্য দেশের আধিপত্য বা চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তি তৈরি করে। বিদ্যুৎ ক্রয়, শাড়ি আমদানি বা ট্রানজিটের মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের নিজস্ব অধিকার ও পছন্দকে সম্মান জানানো জরুরি।