সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা
সাইফুল হক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন ‘ছাত্র ঐক্য ফোরাম’-এর কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জুলাই সনদ নিয়ে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সংকট, বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ কোন দিকে যাবে—এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্য দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু স্বাক্ষর করার পর বিএনপিসহ আপনারা সনদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধিতা করছেন কেন?
সাইফুল হক: অনেকগুলো বিষয়ে একমত হয়েছি, আবার কতগুলো জায়গায় আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তি দিয়েছি। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ সাতটি অঙ্গীকারনামাতেও স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, নোট অব ডিসেন্টের অংশটা ঐকমত্য কমিশনের মূল সনদে নেই। এটা তো বড় ধরনের একটা অসততা। আমরা শুধু নোট অব ডিসেন্টের ওপর আমাদের সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছি। কিন্তু বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সমঝোতা হয়েছিল, নোট অব ডিসেন্টের অংশগুলো মূল দলিলে থাকতে হবে। কীভাবে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো মীমাংসা করা হবে, তার পদ্ধতি নিয়েও সেখানে নোট ছিল। নোট অব ডিসেন্ট ছিল জুলাই সনদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
জুলাই সমঝোতা সনদ (সংবিধান সংশোধন) করার জন্য একটা আদেশ জারি করার পরামর্শ দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। আমাদের যুক্তি ছিল, বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বর্তমান সরকার সংবিধানের ১০৬ ধারার একটা রেফারেন্সের আলোকে শপথ নিয়েছে। সেই ধারার আলোকে সংবিধান নিয়ে সরকার কোনো আদেশ দিতে পারে না। কারণ, তারা নিজেরাই বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে ১৪ মাস ধরে দেশ চালাচ্ছে। এ ছাড়া সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাহী বিভাগ, বিচারব্যবস্থাসহ গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে শত সমালোচনার পরেও এই সংবিধানের অধীনেই। তাহলে যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন, সেই সংবিধানের আদেশ দিয়ে কোনো কিছু সংশোধন করার কোনো ম্যান্ডেট ও ক্ষমতা আপনাদের নেই। তাদের যুক্তি হলো, এটা তো একটা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের সরকার অনেক কিছুই করতে পারে।
আমরা বলেছি, এ যুক্তি হলো খোঁড়া যুক্তি। আপনারা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার, কিন্তু সংবিধান তো বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। সংবিধানের সংশোধনী করতে পারে শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদ। সে জায়গা থেকে আমরা বলেছি, সবকিছু সংসদে গিয়ে রেকটিফাই হতে হবে, সংশোধনীগুলো বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সবকিছু নিয়ে আলাপ-আলোচনার পর আইনে পরিণত হবে। এটাই হলো সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। এর বাইরে তো যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা করা মানেই হলো, আপনারা যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন, সেটাকে অস্বীকার করা এবং প্রকারান্তরে সেই সংবিধানকে বিলুপ্ত করা।
আমার যুক্তি হলো, আপনারা যদি এটাকে অনুমোদন করেন, ভবিষ্যতে কোনো পটপরিবর্তনের সময় সংবিধান পরিবর্তনের জন্য এই ঘটনাটা উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। তখন আর নির্বাচন, সংসদের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। যেকোনো সরকার চাইলেই সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ফিরে আসতে পারে। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই দুটি হলো মেজর পয়েন্ট।
এরপর গণভোটের ব্যাপারে জামায়াতসহ কয়েকটি দল ছাড়া সবাই আমরা বলেছি, আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট একসঙ্গে করার। কারণ, সরকারের পক্ষে দুটি জাতীয় নির্বাচন করার সক্ষমতা নেই। এটার জন্য বিশাল অর্থের ব্যাপার আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করার ব্যাপার আছে। বাস্তবে সে কারণে এটা সম্ভব নয়।
তাহলে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ এভাবে কেন চূড়ান্ত করল? এখানে কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করেন?
সাইফুল হক: সরকারকে দিয়ে যদি তারা আদেশ জারি করতে পারে, প্রকারান্তরে বর্তমান সংবিধান ‘নাই’ হয়ে যায়। যেটা তারা শুরুতে বলেছিল, এটা মুজিববাদী সংবিধান, এটাকে ফেলে দিতে হবে। প্রকারান্তরে এখন তারা বলছে, এই সংবিধানের আর কোনো দরকার নেই। নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে। তারপর আমরা একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করব। যেটা তারা ১৪ মাস আগে করার চেষ্টা করেছিল (যদিও সে সময় সেটা করতে পারেনি)।
এটার উদ্দেশ্যটা হলো রাজনৈতিক কৌশল। যদিও এটার মধ্যে কোনো আন্তরিক উদ্যোগ আছে বলে আমি মনে করি না। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধনীগুলো করতে হবে। মানে ৯ মাসের মধ্যে। কিন্তু কথা হলো, এটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার না। ৯ মাস কোনো ব্যাপার হতে পারে না। এটা দুই-এক মাসের ব্যাপার মাত্র বা সংসদের একটা অধিবেশনে এটা করা সম্ভব। পরে আবার ভয়াবহ একটা কথা বলা হয়েছে, ২৭০ দিনের মধ্যে সেটা করা সম্ভব না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো দেশে কি এভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করার উদাহরণ আছে?
এটা সামরিক ফরমানের মতো করে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার যেন। এ জন্য আমরা বলেছি, কোনো একটা দুরভিসন্ধি আছে বলে অনুমান করা যায়। এটা কি পরিস্থিতিকে জটিল করার জন্য, জামায়াত ও এনসিপিকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়ার জন্য অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না—এ জন্যই তো জটিলতা তৈরি করা হয়েছে।
এখন সমাধানের পথ কী?
সাইফুল হক: এখন সরকার যেটা বলেছে, সেটা আরও ভয়াবহ। সরকার যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বল তুলে দিয়েছে, আমি মনে করি, সেটা খুব অন্যায় কাজ করেছে। আসলে এই সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা। কারণ, তারা দলগুলোর অবস্থান জানে। এখন সমাধানের পথ এবং দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? দাঁড়ানোর জায়গাটা ছিল, দলগুলো যেখানে ঐকমত্য পোষণ করেছে সেটাই তো ঐকমত্যের জায়গা হওয়ার কথা। যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি, সেসব তো কোনোভাবেই সবার সিদ্ধান্ত হিসেবে চাপানো উচিত হয়নি। সমস্যা আসলে তৈরি হয়েছে এখানেই। পরোক্ষভাবে সরকারই এই সংকট জিইয়ে রাখছে কি না, সেই শঙ্কাটা দেখা দিয়েছে। এখন আবার সরকার নিজেরাই সমাধান না করে দলগুলোর ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছে। তবে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে বাকিটা আলোচনা করে সমাধান করা সম্ভব। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন আছে। সমস্যাটা তো এখানেই।
আগামী দিনের নির্বাচন বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ বিতর্কটি কোনো প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?
সাইফুল হক: জুলাই সনদ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যেটা রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের মধ্যে থাকবে। এই সনদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব অংশীজন স্বাক্ষর করেছে, পরবর্তী সংসদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনা হবে, বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং তা আইন হবে। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করবে।
এখন চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান হবে?
সাইফুল হক: এটা নির্ভর করছে সরকারের ওপর। সরকার চাপাতে চাইলে সংকটের সমাধান হবে না। তখন বহুমাত্রিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এমনকি নির্বাচনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। সরকার যদি সংবিধানের কোনো আদেশ দেয়, তাহলে যে কেউ হাইকোর্টে যেতে পারবে। সরকার কোনো বেআইনি কাজ করতে পারে না। প্রচলিত সংবিধান থাকার পরেও কোনো অর্ডার দিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। যদি সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হয়, তখন কী হবে? তখন তো আরেক ধরনের সংকট তৈরি হবে। ফলে সরকার বিতর্কিত পথে হাঁটলেই সংকট, বিভাজন বাড়তে থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হিংসাশ্রয়ী জায়গাটাও তৈরি হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক সংকট
- জুলাই সনদ