কেজি দরের বাটখারায় ‘পরিত্যক্ত’ জাহানারা ইমাম
জাহানারা ইমামের সংগ্রহের বইগুলো একদিন বাংলা একাডেমির গুদামে ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে গেল। কেজি দরে বিক্রি হলো ইতিহাস, বিক্রি হলো স্মৃতি, বিক্রি হলো এক শহীদ জননীর সংগ্রহ, যা তিনি ‘জাতির বিবেকের প্রতীক’ বলে পরিচিত বাংলা একাডেমিকে দান করে গিয়েছিলেন।
বই বিক্রির ঘটনাটি ঠিক কবে ঘটেছে, কেউ জানত না। একমাত্র বাংলা একাডেমি জানে, কারণ তারাই এই বইগুলো ‘পুরোনো এবং পরিত্যক্ত বই’ হিসেবে বিক্রি করেছে। নজরে আসে পুরোনো বই বিক্রির ফেইসবুক পেজ ‘পুস্তক জোন’ কিছু মূল্যবান বই বিক্রির পোস্ট দেওয়ার পর। এরপর ‘প্রথম আলো’তে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও তোলপাড় শুরু হয়।
'পুস্তক জোন' গত ২২ সেপ্টেম্বর জর্জ বার্নাড শ-এর ‘প্লেস আনপ্লিজেন্ট’ বইটি বিক্রির পোস্ট দেয়। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর তারা ‘অচেনা দিগন্ত’ নামের আরেকটি বই বিক্রির পোস্ট দেয়। দেখা গেল, এসব বইয়ের ভেতরে রয়েছে বাংলাদেশের খ্যাতনামা এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সিল। শুধু তাই নয়, ওই বইগুলোতে আরও রয়েছে ‘জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহ’–এর সিলও।
খবরে বলা হয়েছে, জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার অন্তত ২০টি বাংলা ও ইংরেজি বই বাংলা একাডেমি থেকে কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। বইগুলো বিক্রি করছে পুরোনো বই বিক্রি করার কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ রয়েছে ‘বিচিত্র বিচিত্র বই’ পেইজে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হৈচৈয়ের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলা একাডেমি এটি করেছে। দ্বিতীয়ত, বইগুলো জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহের, যা দান করা হয়েছে বাংলা একাডেমিকে। এই বইগুলোর মধ্যে রয়েছে শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ও। ১৯৬৭ সালে এই বইটি শহীদ সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার নিজেই উপহার দিয়েছিলেন ইমাম দম্পতিকে।
তবে এই বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে এসেছে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজমের বক্তব্যও। তিনি বলেছেন, “২০১৪ সালে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছিল বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে কোন বই থাকবে আর কোনটা থাকবে না, তা বাছাই করার জন্য। বাছাই করে জাহানারা ইমামের সংগ্রহশালা যা ছিল, সেগুলো আলমারিতে রেখেছে। আর যেগুলো পরিত্যক্ত, সেগুলো গোডাউনে রাখা হয়েছিল। গোডাউন ভর্তি হয়ে যাওয়ায় সেগুলো নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।”
জাহানারা ইমাম ও শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্মের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। শহীদুল্লাহ কায়সারকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আলবদর-রাজাকার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। অন্যদিকে জাহানারা ইমামের বড় ছেল শহীদ শাফী ইমাম রুমী ১৯৭১ সালে 'ক্র্যাক প্লাটুনের' সদস্য হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ অগাস্ট পাকিস্তানি বাহিনী সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে রুমীকেও আটক করে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। এসকল ইতিহাস এদেশের মানুষের জানা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব স্মৃতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে—বেদনাদায়ক কারণেই।
নব্বইয়ের দশকে জাহানারা ইমাম গঠন করেছিলেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’, শহীদদের হত্যার বিচার দাবিতে। তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ অনেককেই মুক্তিযুদ্ধ চিনতে শিখিয়েছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ত্যাগের দিনলিপি। মুক্তিযুদ্ধের আগে থাকতেই জাহানারা ইমাম লেখালেখি করতেন। পরেও লিখেছেন। কিন্তু তিনি যদি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ছাড়া আর কিছুই না লিখতেন, তবু বাংলাদেশের মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণে রাখত।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বই
- কেজি দরে বিক্রি
- জাহানারা ইমাম