জাহানারার হাহাকার, জাহানারার সাহস
আবারও পুরুষতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হলো বাংলাদেশে। অভিযুক্ত এবার খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড! ফিক্সিংয়ের যে দাগ বাংলাদেশ ক্রিকেটের গায়ে বিভিন্ন সময় লেগেছে, তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এই অভিযোগ। বলা যেতে পারে, জাতীয় পর্যায়ে ঘটা অন্যতম কলঙ্কজনক অভিযোগে অভিযুক্ত হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট।
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম যৌন নিপীড়নের ভয়ানক অভিযোগ এনেছেন। সাহস সঞ্চার করে অশ্রুসিক্ত হয়ে তিনি প্রকাশ্যে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাতে ফুটে উঠেছে হাহাকার ও সাহস। তার বেদনা ও হাহাকারের প্রতি সমবেদনা৷ তার সাহসের প্রতি টুপিখোলা স্যালুট। জাহানারার মতো একজন জাতীয় তারকার এই সাহস নিশ্চয়ই অগণিত ‘মুখ খুলতে না পারা’ নারীকে সাহসী করে তুলবে।
২.
জাহানারা আলমের এই সাক্ষাৎকারের জন্য স্পোর্টস কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ক্রীড়া সাংবাদিক রিয়াসাদ আজিমকে প্রতিষ্ঠিত মেইন স্ট্রিম মিডিয়া হাউজগুলোর সাংবাদিকদের অনেকেই ধন্যবাদ দিচ্ছেন৷ এখন তারা জাহানারা আলমের অভিযোগ নিয়ে সংবাদও করছেন। কিন্তু, সত্য এই যে, তারা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও, এর আগের বিচ্ছিন্ন কিছু ‘অসদাচরণ’ ছাড়া জাহানারা আলমদের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতাগুলো ‘ব্রেক’ করতে পারেননি। ভুক্তভোগীর নাম উহ্য রেখে যথাযথ আইনি নির্দেশনা অনুসরণ করে তারাও যৌন নিপীড়নের সংবাদ সামনে আনতে পারতেন।
পুরুষতন্ত্রের অন্দরে বসে পুরুষতন্ত্রের দরজা ভেঙে ফেলার অনেক ঝক্কি আছে। কোনো রকমে একটা বেঁচে থাকার চাকুরি নিয়ে টিকে থাকেন সাংবাদিকরা—সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের জীবনের শেষ লেখাটির কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। ফলে, এরকম একটা প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্ত ভেঙে ফেলাও সহজ কথা নয়। তবে, সেটা করতে পারলে ভয়ার্ত এক ট্রমা থেকে হয়তো মুক্ত হতে পারতেন জাহানারা আলমরা। আসলে প্রতিষ্ঠানে থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির বাইরে যাওয়ার চর্চা হয় না বলেই, জাহানারা আলমকে ক্যামেরার সামনে বসাতে পেরেছেন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরি না করা রিয়াসাদ আজিম।
রিয়াসাদ আজিমের ধন্যবাদ তাই প্রাপ্য, তবে ততোধিক প্রেরণা ও সম্মান প্রাপ্য জাহানারা আলমের। সেলিব্রেটিদের জীবন সহজ নয়। কঠিনই। জাহানারারও তা-ই। দেশের একজন জনপ্রিয় নাগরিক হিসেবে এই আবদ্ধ কারাগার ভেঙে দিয়ে তিনি যে কী সাহস সঞ্চার করলেন বহু নারীর জন্য তা হয়তো এখন বোঝা যাবে না। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে তার এই সাহসকিতাকে একাডেমিয়ায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করা হবে।
এই সনাতন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ভাঙতে হলে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মানসিকতার (এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট টেম্পারমেন্ট) চর্চাটা খুব জরুরি। জাহানারা যা সাহস ও আবেগের সমন্বয়ে করতে পেরেছেন, সেটা বুকিশ বা কেতাবি নয়। বুকিশ চর্চা থাকলে পারতেন না। নারী বা নানামাত্রিক নিম্নবর্গদের সবকিছু 'মেনে নেওয়ার' তালিম দেওয়ারই অপর নাম বুকিশ চর্চা। জাহানারা এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট টেম্পারমেন্টের শক্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি ভাঙার সাহস করেছেন বলেই কথাগুলো তুলতে পেরেছেন।
ফলে, মিডিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিকেও প্রশ্ন করা জরুরি। কেন জরুরি, তার একটি উদাহরণ থাকল এখানে।
৩.
এবারের নারী বিশ্বকাপ অতীতের যে কোনো বিশ্বকাপের তুলনায় অনেক বেশি বৈশ্বিক মনোযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অসাধারণ টুর্নামেন্ট হয়েছে৷ নারীদের পেশাদার মানসিকতার প্রশংসা করলেও কম বলা হবে৷
টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে স্বাগতিক ভারত। এই জয়কে ১৯৮৩ সালে ভারতের পুরুষ দলের বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গে তুলনা করছে ভারতীয় মিডিয়া৷ দুটিরই একই মিল—প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছে এশিয়ার কোনো দেশ। তিরাশির সেই বিশ্বকাপ শুধু ভারত নয়, উপমহাদেশেরই ক্রিকেটীয় মানচিত্র বদলে দিয়েছিল৷ ইতিমধ্যেই তখন টেস্ট খেলা পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা আরও এগিয়ে গেল। বাংলাদেশও নতুন উদ্যমে শুরু করল এক পা, দুই পা করে।
শ্বেতাঙ্গ সাহেবের তৈরি করা নিয়মের এই খেলায় প্রাক্তন কলোনিগুলো যে দাপট দেখাতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রথম প্রমাণ ছিল ক্যারিবিয়ানরা। কিন্তু, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বিত্তশালী উপনিবেশ ভারতবর্ষ (সব দেশ মিলিয়ে) সমস্ত বঞ্চনার জবাব দেওয়ার জন্য জন্ম দিল ১৯৮৩ সালের, আজকের ভারত হলো তার প্রতিনিধি।
এরপর, ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপ আসর সাহেবের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যখন প্রথমবারের মতো দারিদ্র্যপীড়িত গরিবের কুটিরে আয়োজিত হলো, তখন বদলে গেল বিশ্ব ক্রিকেট ও তার অর্থনীতি। ক্রিকেটে একাদিক্রমে রাজত্ব শুরু করল ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা। একটা খেলা হয়ে উঠল এ অঞ্চলের জীবন-মরণের ‘সমস্যা’। ধর্মাতীত আবেগ। সেই আবেগে গা ভাসল বাংলাদেশেরও।
১৯৮৩ থেকে ২০২৫—এই ৪২ বছরে দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক বদলে গেছে৷ ফলে, অপার শক্তিশালী সব দলের বিরুদ্ধে জিতে ভারতীয় মেয়েদের প্রথম এশিয়ান দল হিসেবে এই বিশ্বকাপ জয় এই পুরো অঞ্চলের মেয়েদের ওপর তিরাশির মতো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না, তা নির্ভর করছে প্রতিবেশী দেশগুলোর বর্তমান ও আগামীর রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপরে। তখন সম্পর্কগুলো আজকের মতো ছিল না৷ একের প্রতি অন্যের নিষেধাজ্ঞা ছিল না৷ পেশাদার সফর বিনিময় ছিল। ছিল হৃদ্যতা। ছিল রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির উর্ধ্বে উঠতে পারার সক্ষমতা৷
এখন এসব বদলে গেছে। কোন্দল আর যুদ্ধংদেহী মানসিকতায় ন্যূনতম পেশাদার সৌজন্যবোধটুকুও আজ অস্তগামী। যদিও, সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের জেমিমা রড্রিগেজের অসামান্য ম্যাচজয়ী ইনিংসের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের মারুফা আক্তারের মন্তব্য ও সেটার প্রত্যুত্তরে জেমিমার মন্তব্য দেখে বোঝা যায়, খেলোয়াড়রা দেশ-ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতির উর্ধ্বে গিয়ে নিজেরা নিজেদের কাছ থেকে পেশাদার অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করছেন৷ বলাবাহুল্য, জেমিমা ও মারুফার সেই উত্তর-প্রত্যুত্তরের একটা ফটোকার্ড ভাইরাল হয়েছে৷