প্রত্যাশিতভাবেই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গের বৈঠক থেকে নিজেদের উত্তরটি পায়নি বিএনপি। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬ এর মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিতে অটল ছিলেন এবং বিএনপি অনড় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে। আগের বৈঠকগুলোর সঙ্গে এবারের পার্থক্য হলো—এই প্রথম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে দলটির মন্তব্য এলো, তারা 'একেবারেই সন্তুষ্ট নয়'।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিএনপিকে 'অসন্তুষ্ট মনে হয়নি' এবং জোর দিয়ে বলেছেন, 'নির্বাচন কোনোভাবেই জুনের পরে যাবে না'। এর ঠিক আগেই তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের 'আমরা যদি কোনো বিচার না করে যাই, কোনো বিচার না করে যদি নির্বাচন দেই, মানুষের কাছে নিজের কাছে জবাব দেবো কীভাবে?'
বিচার ও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে তার এই বক্তব্য দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিচারিক প্রক্রিয়া কি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সম্পন্ন করা যাবে? সেক্ষেত্রে সেটা কি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম ইতোমধ্যেই এমন কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন।
জামায়াত আমির বলেছেন, আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। তার মানে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাইছেন তিনি। এটাকে যুক্তিসঙ্গত মধ্যপন্থা বলেই মনে হচ্ছে।
নির্বাচনের পক্ষে যারা রয়েছেন তারা মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। এতে জনগণ তাদের নেতা নির্বাচনের অধিকার ফিরে পাবে, স্বচ্ছভাবে আলোচনার মাধ্যমে নীতি অনুমোদন করার মতো কার্যকর সংসদ পাবে এবং জবাবদিহিমূলক সরকার পাবে। 'অন্তর্বর্তী' সরকারব্যবস্থা শেষ হবে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রা আবার শুরু হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অনিশ্চয়তার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা শেষ হয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
বর্তমানে পুরো বিশ্ব আমাদের সঙ্গে যে সম্পর্ক রাখছে তা মূলত ড. ইউনূসের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার কারণে। তার মতো একজন নেতার নেতৃত্বাধীন থাকা যত গর্বেরই হোক না কেন, সেটা জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো সরকারের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার বিকল্প হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন থেকেই গণতন্ত্র ছিল আমাদের গর্বের জায়গা। শেখ হাসিনা আমাদেরকে সেই গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। কাজেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নির্বাচিত সরকার গঠনে অযথা বিলম্ব প্রত্যাশিত না।
যারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় না তারা মনে করে, এই সময়ের মধ্যে সংস্কারের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে না এবং এখনই নির্বাচন হলে আগের সেই দুর্নীতিপরায়ণ, পরিবারতান্ত্রিক ও একব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাই ফিরে আসবে। তাদের যুক্তি, আমরা যদি সেই আগের রাজনীতিতেই ফিরে যাই, তাহলে দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাদের এই যুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনোভাবেই অবহেলা করার মতো নয়। ভবিষ্যতে আমরা যাই করি না কেন, সেখানে এই গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা—গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সব শ্রেণি ও ব্যক্তির অধিকার, সমতা, বৈষম্যহীনতা, আইনের শাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহি প্রভৃতি থাকতে হবে।
কিন্তু, সংস্কার জরুরি হলেও সেটাকে নির্বাচন বিলম্বের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত না। সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি নির্বাচিত সরকারও জরুরি। দ্য ডেইলি স্টার এবং আমি নিজেও বারবার বলেছি যে সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই দরকার এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই সেটা সম্ভব।