
শান্তির সংস্কৃতির পদযাত্রা
বিশ্বনাট্য দিবসের সূচনা ১৯৬১ সালে হলেও বাংলা ভাষায় নাট্যচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই কবে ১৭৯৫ সালে গেরাসিম লেবেদেফের হাত ধরে কলকাতায় প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয়েছিল বাংলা নাটক। ২৩০ বছরে নাটকের আঙ্গিকে, প্রকরণে, মঞ্চসজ্জায়, অভিনয়ে, আলো ও শব্দের ব্যবহারে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, সে কথা না বললেও চলে। নাটকে নিবেদিতপ্রাণ প্রবীণ নাট্যামোদী পরিচালক এবং নাটকপ্রিয় একদল তরুণ নাট্যকর্মী তাঁদের শ্রমে ও প্রতিভায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর আমাদের নাটককে একটি মানসম্পন্ন আধুনিক শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, চলচ্চিত্র, নাটকসহ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সম্ভাবনার যে দ্বার খুলে দিয়েছিল, নির্দ্বিধায় বলা যায় তা সবচেয়ে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন নাট্যজনরা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ঢাকার মঞ্চে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ পরিচয়ে এক নতুন নাট্য আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধতে থাকে। স্বাধীনতার আগে নাটকের মঞ্চায়ন প্রধানত শৌখিন নাটকের দল এবং ব্যাংক-বীমা কিংবা অফিস-আদালতের কর্মকর্তাদের বার্ষিক বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এসব নাটকে হালকা হাসি থেকে স্থূল হাস্যরস পর্যন্ত পুরো নাটকের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সাময়িক বিনোদন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, মঞ্চের দর্শক নাটক দেখতে আগ্রহ বোধ করে মূলত বিনোদনের প্রত্যাশায়। স্বাধীনতা-উত্তর গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দর্শকের আকাঙ্ক্ষাকে সাধারণ মনোরঞ্জনের স্তর থেকে পরিশীলিত বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। সংলাপের মধ্য দিয়ে যেসব তথ্য, তত্ত্ব ও দর্শন এবং ব্যাপক অর্থে চিন্তা-চেতনা দর্শকের মনোজগতে সঞ্চারিত হয়, তা নাটকের যবনিকা পতনের পরেও দর্শককে ভাবতে সহায়তা করে। এ সময়ে রচিত ও মঞ্চস্থ নাটকে তুলে ধরা হয়েছে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, সমাজের নানা অসংগতি, গণমানুষের অধিকার এবং সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির প্রসঙ্গ।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের ভূমিকা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতি ও দুর্বলতার সুযোগে সমাজে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের বিষয়ও নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
স্বাধীনতার আগে শৌখিন নাটকের দলগুলো প্রধানত কলকাতাকেন্দ্রিক নাটকের পাণ্ডুলিপি অথবা প্রসাদ বিশ্বাস, কল্যাণ মিত্রের মতো জনপ্রিয় নাট্যকারের নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী ছিল। কিছুসংখ্যক অভিজাত ক্লাব এবং দু-একটি নাট্য সংস্থা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সাঈদ আহমদ, আশকার ইবনে শাইখের নাটক মঞ্চায়ন করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নতুন দলগুলোর চাহিদার কারণে আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হক, জিয়া হায়দার, সেলিম আল দীন, এস এম সোলায়মান, মমতাজউদদীন আহমদ, সৈয়দ মহিদুল ইসলাম, জিয়া আনসারীসহ বেশ কয়েকজন নতুন নাট্যকারের লেখা নাটক বাংলাদেশের মঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ও মীর মশাররফ হোসেন মঞ্চে এসেছেন নতুন আঙ্গিকে।
ঢাকা শহরের দর্শক এই সময় বিপুলসংখ্যক অনূদিত ও রূপান্তরিত নাটক দেখার সুযোগ লাভ করেছে। শেকসপিয়ার, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, মলিয়ের, ব্রেখট, টেনাসি উইলিয়ামস এবং ইউজিন ও’নিলের মতো নাট্যকারদের চিরায়ত নাটকের সঙ্গে বাংলাদেশের দর্শকের পরিচয় ঘটেছে।
সত্তর ও আশির দশকজুড়ে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশের অনেক শহরেই নতুন নাট্যচর্চা প্রসার লাভ করেছিল। নিয়মিত নতুন নাটক মঞ্চায়ন, দর্শনীর বিনিময়ে নাটকে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি, নাটকের অগ্রযাত্রাকে সে সময় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে নাট্য প্রতিযোগিতা, যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে পথনাটক রচনা ও তাত্ক্ষণিক মঞ্চায়ন এবং একদল নতুন নাট্যকারের আবির্ভাব ও কুশলী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পদচারণে মুখর নাট্যাঙ্গন দেশে একটি নাট্য সংস্কৃতি বিনির্মাণে সাফল্য অর্জন করেছিল বলা যায়। এর ফলে ‘নাটক সমাজ বদলের হাতিয়ার’—এই জনপ্রিয় স্লোগানটি দীর্ঘদিন ব্যাপক উদ্দীপনার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও বাংলাদেশের নাটক মঞ্চস্থ ও প্রশংসিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক নাট্য সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা একাধিকবার সভাপতিসহ উচ্চতর সম্মানজনক পদ অলংকৃত করেছেন।
বিগত কয়েক দশকে নাটকের ক্ষেত্রে আরো দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমাদের নাট্যাঙ্গনের সৃজনশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, তা হলো দেশি-বিদেশি নাটকের দলের সমন্বয়ে প্রতিবছরই নাট্যোৎসব আয়োজন ও নাট্যকলায় প্রথাগত শিক্ষা। নাট্যোৎসবগুলো অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং নিজস্ব প্রযোজনায় উৎকর্ষ লাভের ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশে ও বিদেশে নাট্যকর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলার প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্র উন্মোচিত হওয়ার ফলে প্রতিবছরই মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হতে শুরু করেছে। তবে নাট্যকলায় শিক্ষা অর্জনের পর সবারই যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজের সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে তা নয়। দেশের বেশির ভাগ মানুষকে সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্রসহ সব ধরনের সুকুমার কলার যে জগৎ তার বাইরে রেখে নাটকে কর্মসংস্থান বা নাটকের উত্তরোত্তর সাফল্য আশা করা যায় না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্বনাট্য দিবস