ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার গঠনমূলক উপাদান একাধিক, সেগুলো হলো: বিজেপির নেতৃত্বে কাশ্মীরকে পুরো আত্মীকরণের ভারতীয় চেষ্টা, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কিছু উস্কানিমূলক বক্তব্য ও পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ, যুক্তরাষ্ট্রে এক যুদ্ধবাজ উগ্র প্রেসিডেন্টের আবির্ভাব, ইসরায়েলি মডেলের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ও এক স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতির বিকাশ।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বুঝতে হলে এই উপাদানগুলোকে বিবেচনার মধ্যে নিতে হবে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্ন। ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তির সময়েই কাশ্মীর স্বাধীনতা হারায় জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার একাংশের ভারতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। এরপর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু জম্মু ও কাশ্মীরে একটি গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ধূর্ততার সঙ্গে সবসময় এড়িয়ে যাওয়া হয়। কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারটি ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই অবজ্ঞা করে। তবে কাশ্মীরের ভারত-নিয়ন্ত্রিত অংশেই অসন্তোষ বেশি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠতে থাকে। যাতে পাকিস্তানেরও কমবেশি ভূমিকা রয়েছে। আর সেই ভূমিকার ছুতায় ভারত সেখানে দমন-পীড়ন, জেলজুলুম, হত্যা-ধর্ষণ সবকিছু চালিয়ে তাকে এক স্থায়ী পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে রেখেছে। এভাবে ফিলিস্তিনের ও কাশ্মীরের উভয় জনগোষ্ঠী হয়ে আছে স্বভূমে পরবাসী।
২০১৯-এ ভারতের মোদী-পরিচালিত বর্তমান সরকার কর্তৃক সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর তার বিশেষ মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয় এক দখলিকৃত ঔপনিবেশিক ভূমিতে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেখানে প্রবর্তন করে কারাগারের নিরাপত্তা-শৃঙ্খলা ও কবরের শান্তি যাকে তার সরকার স্থিতিশীলতার উদাহরণ বলে প্রচার চালিয়ে পর্যটন ব্যবসা অব্যাহত রেখেছিল। সেই দাবিই ফুটো হয়ে যায় সাম্প্রতিক পেহেলেগামে সন্ত্রাসী হামলা ও ২৬ জন নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এই হামলায় প্রত্যক্ষ মদত থাকুক বা না থাকুক, পাকিস্তানের দিক থেকে উস্কানির অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পেহেলগামে হামলার কয়দিন আগে ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনীর ইসলামাবাদে এক সভায় যে বক্তব্য দেন তা খুবই অবিবেচনাপ্রসূত। তিনি বলেন, “আমরা হিন্দুদের থেকে আলাদা।” তিনি কাশ্মীরকে বলেন পাকিস্তানের ‘গলার শিরা’ এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে, পাকিস্তান কখনো ভারতের দখলদারির বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে সমর্থন দেয়া থেকে পিছপা হবে না।
পাকিস্তান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এবং সেখানে সংখ্যায় খুব উল্লেখ করার মতো না হলেও হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান হয়েও তিনি অতি উৎসাহে মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে ফেলে কেবল মুসলমানদের সেনাপতি হয়ে গেলেন! অথচ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের ১১ অগাস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন যে, পাকিস্তানে সকল নাগরিক সমান অধিকারের ভিত্তিতে জীবনযাপন করবে, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সেখানে আসিম মুনীরের এ ধরনের সংঘাত সৃষ্টির সহায়ক বক্তব্য দেয়ার কারণ কী? নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে নাকি নতুন এক যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরানোর জন্য?
আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান পাকিস্তানি লেখক তারিক আলী নিউ লেফট রিভিউতে (অন দ্য ব্রিংক, ৩ মে ২০২৫) এ সম্পর্কে লিখেছেন, জেনারেল মুনীরের নিজেকে ভারতীয় মোদীর সামরিক পোশাকপরা পাকিস্তানি সংস্করণ হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস এক চরম ব্যর্থতা। প্রথমত, হিন্দুরা সবসময়ই শত্রু এবং মুসলমানরা তাদের সঙ্গে একত্রে থাকতে পারে না— এ হলো মুসলমান সম্পর্কে মোদীর দাবির ‘বিপ্রতীপ প্রতিধ্বনি’।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে ভারতের খ্যাতিমান লেখক অরুন্ধতী রায় বলেছেন, “পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়ায়নি, জড়িয়েছে এদের সরকার। তাদের ব্যবসায়ী গোষ্ঠি, চলচ্চিত্র শিল্প ও জনগণ একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না। এই যুদ্ধ আসলে একটা নাটক যা সীমান্তের দুই পারের শাসকগোষ্ঠির রচনা যারা ভয় ও ঘৃণা থেকে মুনাফা করে। ভারত ও পাকিস্তানের সুবিধাভোগী গোষ্ঠি জাতীয়তাবাদ ও কাশ্মীর বিষয়কে জিইয়ে রাখে দারিদ্র্য, অসাম্য এবং সরকারি ব্যর্থতা ও নির্যাতন থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানোর উদ্দেশ্যে।”
এরপর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণে যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতালাভ বহুল আলোচিত এবং স্পষ্টত দৃশ্যমান। এই যুদ্ধের দামামার পেছনে ভারতের ইসরায়েলি মডেল থেকে শিক্ষার বিষয়টি বরং আলোচনা করা যাক। ইসরায়েল মডেলের জন্ম জায়নবাদীদের হাতে যারা ফিলিস্তিন দখল করতে হেন কোনো অপরাধ নেই যা করতে পিছপা হয়।