
দেশ আজ জনগণের হাতে নেই
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন একটি স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দমন-পীড়ন, নির্বাচনী ব্যবস্থার ভেঙে পড়া কাঠামো এবং প্রচলিত দেউলিয়া রাজনীতির বিপরীতে তরুণদের নবজাগরণ এমন এক সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করতে পারত। ‘জুলাই বিপ্লব’ নাম দেওয়া হয়েছিল এই আন্দোলনকে, যার উদ্দেশ্য ছিল দলীয়করণ, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করা। একটি নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থান আশা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের জুলাইয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, পরিবর্তনের নামে উত্থান ঘটেছে একদল নতুন চাঁদাবাজ, ধর্ষক, প্রতারকের। কেন এমন হলো?
বাংলাদেশে রাজনীতির যে কোনো নবীন জোয়ার প্রথমেই যেটার মুখোমুখি হয়, তা হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো এবং চরিত্র বিকৃতির চক্র। এটি এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষ নয়, চরিত্র নয় বরং সুযোগ, সম্পদ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। ড. ইউনূসের মতো একজন খ্যাতিমান মানুষ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে জুলাই আন্দোলনের সামনে থাকা তরুণদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আংশিক দরজা খুলে দিয়েছেন—সচিবালয়, ডিসি অফিস, এমনকি বিচারালয়েও তাঁদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলাফল—চরিত্রচ্যুতি।
রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তরুণদের ব্যবহার করেছিলেন একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের মুখোশ হিসেবে। কিন্তু মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক ভয়াবহ ক্ষমতালিপ্সা। সে জন্যই যাঁরা একসময় হলে বা মেসে থেকে আন্দোলনের পরিকল্পনা করতেন, তাঁরাই এখন ফ্ল্যাট কিনেছেন অথবা গ্রামের ভাঙা বাড়ির জায়গায় পাকা দালান গড়ে তুলছেন। যাঁদের পকেটে চা খাওয়ার পয়সা ছিল না, তাঁদেরও এখন রমরমা অবস্থা। এটি সামাজিক উন্নয়ন নয়, এটি রাজনৈতিক পুঁজির আত্মসাৎ। আত্মসাৎ তখনই ভয়াবহ হয়, যখন সেটি আদর্শের নামে করা হয়। এই তরুণেরা যখন চাঁদাবাজি করেন, তখন তাঁরা শুধু অর্থ আত্মসাৎ করেন না, একটি জাতির বিশ্বাস এবং স্বপ্নকেও লুণ্ঠন করেন। এই বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত এতটাই গভীর যে, ভবিষ্যতের কোনো তরুণ যদি আদর্শ নিয়ে এগিয়ে আসতে চান, তাঁকে বিশ্বাস করতে দেশের মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হবে।
এখন বাংলাদেশের নানা প্রান্তে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি, ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে। একদিন যাঁরা ছিলেন মুক্তির প্রতীক, তাঁদের কেউ কেউ আজ সামাজিক ঘৃণার পাত্র। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল কষ্ট পেয়ে বলছেন, ‘বেদনায় নীল হয়ে গেছি।’ কিন্তু ফখরুল সাহেব কি ভুলে গেছেন যে, তাঁর দলের কিছু নেতা-কর্মীও একসময় ঠিক এই কাজগুলো করতেন, এমনকি এখনো করছেন? চাঁদাবাজির অভিযোগ তো বিএনপি, জামায়াতের বিরুদ্ধেও উঠছে। সংবাদপত্রে কিছু কিছু ছাপাও হচ্ছে।
যেসব অপকর্মের জন্য আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, সেসব অপকর্মের অভিযোগ জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়ী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধেও উঠছে। আত্মহননের রাজনীতির পথযাত্রা দেশের মানুষকে দেখতে হচ্ছে।
আসল ট্র্যাজেডি এখানে যে, এসব করে মূলত জনগণের সঙ্গেই প্রতারণা করা হচ্ছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা তরুণদের দেখে আশায় বুক বেঁধেছিল, যারা এই আন্দোলনকে তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রতিবাদ হিসেবে দেখেছিল, তারা আজ আবার এক নতুন হতাশায় ডুবে গেছে। জুলাই বিপ্লবের নামে ক্ষমতা দখল করে, জনগণের প্রত্যাশা হরণ করে রাষ্ট্রের ভেতরে গড়ে ওঠা এই নতুন প্রজন্ম যদি চরিত্রের পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের ক্ষমতা দখলের নৈতিক ভিত্তি থাকে না। এ অবস্থায় রাজনীতি হয়ে যায় শুধুই প্রতারণার এক নতুন নাম।
জুলাই চেতনা আজ একটি অসমাপ্ত বিপ্লবের নাম। এটা এখনো ইতিহাস হয়ে ওঠেনি, কারণ এর পরিণতি এখনো নির্ধারিত নয়। এই পচনের বিরুদ্ধে যদি নতুন কোনো আত্মশুদ্ধির আন্দোলন না হয়, তাহলে এই বিপ্লব ইতিহাসে লেখা হবে একটি ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে। এখনো সময় আছে, এখনো কিছু ভালো মানুষ আছেন—তাঁদের প্রয়োজন এক নতুন স্বীকারোক্তির। ক্ষমতার লোভকে অস্বীকার করে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। রাষ্ট্রকে বদলাতে হলে নিজেকে আগে বদলাতে হয়। অন্যথায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলনে বিজয়ী শক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।