
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতি
১ আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি। ৩১ জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ ছিল বিভিন্ন দেশের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করার। এ বছরের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করার পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন যে, এতদিন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানান অন্যায্য সুবিধা নিয়েছে এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
ফলে, দেশটি বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির চাপে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এপ্রিলের প্রথম দিকেই যুক্তরাষ্ট্রে নানান দেশের রপ্তানির ওপরে নানান রকমের শুল্ক ধার্য করেছিলেন। বলা প্রয়োজন সে শুল্ক ধার্য ছিল একেবারেই একতরফা এবং বস্তুনিষ্ঠ নির্ণায়ক বহির্ভূত।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একতরফাভাবে ধার্যকৃত শুল্ক ছিল প্রচলিত শুল্কহারের চেয়ে বেশি এবং প্রস্তাবিত এই শুল্কের কোনো বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি ছিল না। ফলে তার এই একপাক্ষিক শুল্কনীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে, একে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয় এবং পাল্টা শুল্কের হুমকিও দেওয়া হয়।
এসব সমালোচনা করা দেশগুলোর মধ্যে চীন ছিল সবচেয়ে সোচ্চার। বাকি বিশ্বের চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, সব দেশের জন্যে ধার্যকৃত শুল্ক ৯০ দিনের জন্যে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো এবং এই সময়সীমার মধ্যে সব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যের ভিত্তিতে শুল্কহার ও বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করতে হবে। ৩১ জুলাই ছিল সেই ৯০ দিন সময়সীমার শেষদিন।
শেষ তিন মাসে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে একাধিকবার এসেছে, মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানান বৈঠকে বসে মতৈক্যের ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে সময় থাকতে যুক্তরাজ্য এবং ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে মত্যৈক্যভিত্তিক শুল্ক আরোপিত হয়েছে—যুক্তরাজ্যের জন্যে ১০ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্যে ২৯ শতাংশ।
ইতিমধ্যেই জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যে ১৫ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার জন্যে মার্কিন শুল্ক হচ্ছে ১৯ শতাংশ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির অধীনে ভারতের ক্ষেত্রে শুল্ক ধার্য করা হয়েছে ২৫ শতাংশ এবং পাকিস্তানের জন্যে ২৯ শতাংশ। অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দেশের ক্ষেত্রেও এমনতরো মতৈক্যে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের সঙ্গে কয়েকদিনের আলাপ-আলোচনায় কোনো মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি এবং দুই সপ্তাহের জন্যে সাময়িক বিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবেন। ১ আগস্ট পর্যন্ত এই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ধার্যের সামগ্রিক সাম্প্রতিকতম চালচিত্র। তবে এ পুরো প্রক্রিয়ার কয়েকটি দিক উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ব্যাপারটি ছিল বহুদেশ-ভিত্তিক, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পুরো ব্যাপারটির প্রক্রিয়া চালিয়েছে দ্বিপাক্ষিকভাবে—প্রতিটি দেশের জন্যে আলাদা আলাদা করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুপাক্ষিক কোনো প্রক্রিয়া ব্যবহার করেননি এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক সংস্থা, তার নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করেছেন।
এর কারণ ত্রিবিধ। এক, এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো বহুজাতিক কাঠামোর কাছে জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত রেখেছেন।
দুই, দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মাধ্যমে প্রতিটি দেশকে আলাদা আলাদা চাপের মুখে রেখে তিনি সর্বাধিক সুবিধা আদায় আদায় করতে চেয়েছেন।
তিন, বহুপাক্ষিক কাঠামো ব্যবহার না করার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন দেশকে সম্মিলিত হতে না দিয়ে 'বিভাজন ও শাসন' এর মাধ্যমে তার বাণিজ্য প্রতিপক্ষদের দুর্বল করে দিয়েছেন। বলা প্রয়োজন, তার এই কৌশলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য চিরায়ত প্রথাগত বিশেষ বিবেচনাকেও তিনি জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি