
খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা এবং ‘নিয়তির সন্তান’ তারেক রহমান
চিকিৎসার জন্য চার মাস বিদেশে থাকার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী বিমানবন্দর সড়কে ভিড় করেছিলেন। তাঁরা ‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘খালেদা জিয়া ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ স্লোগান দেন। অনেকের হাতে ফুল, রঙিন ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড ছিল।
গত জানুয়ারি মাসে যখন খালেদা জিয়া লন্ডন যান, তখন নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল, কবে তাঁর চিকিৎসা শেষ হবে? কবে দেশে ফিরবেন? চিকিৎসক ও দলের নেতা-কর্মীরা জানালেন, তিনি আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। গাড়ি থেকে নেমে নিজেই হেঁটে বাসায় গেছেন।
খালেদা জিয়ার সুস্থতা নিশ্চয়ই নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করবে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর খালেদা জিয়া সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও দলের নেতা-কর্মীরা তাঁর ওপরই বেশি ভরসা রাখেন। দলের ঐক্যের প্রতীক মনে করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালে খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করলেও বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি। কার্যত তিনি অন্তরিন ছিলেন। বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁর জামিনের আবেদন করা হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়। অথচ একই ধরনের মামলায় দণ্ডিত এইচ এম এরশাদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ও নাজমুল হুদা জামিন পেয়েছেন। কারাবন্দী অবস্থায় হাজি সেলিমকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু খালেদা জিয়াকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটাই হলো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রবীণ নারীর প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের ‘মহানুভবতার’ নমুনা।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা ১৭ বছর ধরে রাজপথে আছেন। কিন্তু মঙ্গলবার তাঁদের রাজপথে থাকার ঘটনাটি ছিল ভিন্ন আবহের। তাঁরা দূর থেকে নেত্রীকে একবার দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খালেদা জিয়াও হাত নেড়ে তাঁদের শুভেচ্ছার জবাব দিয়েছেন।
দলের নেতারা তাঁকে রাজনীতিতে আবার সক্রিয় দেখতে চান। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা গণতন্ত্র উত্তরণের পথ সহজ করবে।’ স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘তিনি তো রাজনীতিতে সক্রিয় আছেনই। আমরা সব সময় তাঁর কাছ থেকে নির্দেশনা নিতাম।’ খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না, জানতে চাওয়া হলে এই নেতা কৌশলী উত্তর দেন, ‘নির্বাচন এলে দেখা যাবে। আগে নির্বাচনের ঘোষণা আসুক।’
একজন রাজনীতিকের সত্যিকারের জনপ্রিয়তা পরিমাপ করা হয় ক্ষমতার বাইরে থাকতে। ক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম ও দলীয় কর্মীরা নেতা-নেত্রীর বন্দনায় মগ্ন থাকেন। আবার তাঁরাও কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে ‘বাধ্যতামূলক’ সমীহ আদায় করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন। কিন্তু ক্ষমতা থেকে চলে গেলে সেই জনপ্রিয়তা বুদ্বুদের মতো উবে যায়।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। তিনি ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে এবং ৬ বছর প্রায় বন্দিজীবন যাপন করার পরও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। এমন বহু মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা বিএনপির রাজনীতি করেন না, বিএনপির নীতি-আদর্শেরও সমর্থক নন, তাঁরাও রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়াকে পছন্দ করেন। এটি তিনি অর্জন করেছেন ব্যক্তিগত সৌজন্যবোধ ও মৃদুভাষিতা দিয়ে। আমাদের অতিকথনের রাজনীতিতে কম কথা বলাও বড় গুণ।
খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন আশির দশকের গোড়ার দিকে, যখন দলের বাঘা বাঘা নেতা সেনাশাসক এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও তরুণ কর্মীদের সহযোগিতায় দল পুনর্গঠিত করেন। তিনি এরশাদের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আপসহীন খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিতের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে বিএনপি যে জয়ী হয়, তার পেছনেও মূল চালিকা শক্তি ছিলেন খালেদা জিয়া। অনেক নেতা বা নেত্রী দলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ান। আর অনেক নেতা-নেত্রী নিজের ভাবমূর্তি দিয়ে দলকে এগিয়ে নেন। খালেদা জিয়া দ্বিতীয় সারিতে পড়েন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দেশে ফেরা
- বিদেশে চিকিৎসা