দুর্ভিক্ষের সেই স্মৃতি এখনো কাতর করে

যুগান্তর এলাহী নেওয়াজ খান প্রকাশিত: ০৯ মে ২০২৫, ১১:৪৭

বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান অতিথির ভাষণে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। মনে হলো, তিনি বুঝি চোখের পানিতে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছেন। কিংবা বলা যায়, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রচণ্ড আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। যারা সে সময় চুয়াত্তরের সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং দুঃসহ কষ্ট নিয়ে দিন যাপন করেছিলেন, তারা নিঃসন্দেহে প্রফেসর ইউনূসের এ কান্নাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। ঢাকায় সেই দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস ছিল খুবই ভয়াবহ। যারা তখন ঢাকায় বাস করতেন, তারা দেখেছেন সদ্য স্বাধীন দেশে মানবসৃষ্ট সেই মানবিক বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ ছিল।


আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মার্চ মাসে আর শেষ হয়েছিল ডিসেম্বরে। ঠিক একইভাবে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল মার্চ মাসে আর শেষ হয়েছিল ডিসেম্বরে। অর্থাৎ নয় মাস ধরে প্রতিটি শহরে, নগরে, গ্রামে, পথে, প্রান্তরে চলেছিল ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার, আর মৃতদের শবযাত্রা।


তখন কঠিন নিবর্তনমূলক শাসন এবং সংবাদপত্রে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা সত্ত্বেও দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদ, গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক হক কথা, ডেইলি অবজারভার ইত্যাদি দৈনিক পত্রিকাগুলোতে কমবেশি দুর্ভিক্ষের খবর ছাপা হতো। সেসব খবর ছিল হৃদয়বিদারক। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না সহ্য করতে না পেরে পিতা তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে ছুড়ে মারছে পানিতে। খাবার দিতে অপারগ মা শিশুকে হত্যা করছে। যৎসামান্য যা কিছু ত্রাণ প্রদান করা হতো কিংবা যেসব নোঙরখানা খোলা হয়েছিল, সেখানেও খাদ্য ছিল অপ্রতুল। আর বেশিরভাগ নোঙরখানাই শহর এলাকায়। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ নোঙরখানায় ভিড় জমাত। প্রয়োজনের তুলনায় নোঙরখানার সংখ্যা ছিল অনেক কম। ফলে দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরও না খেয়ে ফিরে আসতে হতো অনেককেই।



আর তখন যারা গ্রামেগঞ্জে বাস করতেন, তাদের পরিণতি সম্পর্কে খুব কমই জানা যেত। কারণ সেসময় তো এখনকার মতো এত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না প্রযুক্তির এত উন্নততর ব্যবহার। আজ যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অত্যন্ত গ্রামের একটি ছোট্ট ঘটনার খবরও মুহূর্তের মধ্যে আমরা পেয়ে যাই। তাই ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর ইউনূসের চোখে ভেসে উঠেছিল না খেয়ে মরে পড়ে থাকা কঙ্কালসার কৃষিজীবীর মুখোচ্ছবি। দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের করুণ দুর্দশার কথা হয়তো মনে পড়ায় প্রফেসর ইউনূস আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন, তখন গ্রামগঞ্জের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। ফি বছর পানিতে ডুবে যেত পথঘাট, মাঠ, পথপ্রান্তর। যে বছর আকস্মিক বন্যায় ধান-পাট নষ্ট হয়ে যেত, সে বছর কষ্টের আর সীমা থাকত না। ’৭৪ সালেও একটা বড় বন্যা হয়েছিল। বছরে একবারই ধান উৎপাদন হতো। ধানের মধ্যে ছিল আউশ, আমন ও বোরো। নগদ ফসল বলতে ছিল শুধু পাট। তখন গ্রামে নগদ টাকার প্রচলন খুব কমই ছিল। মানুষ ধান-চালের বিনিময়ে কেনাকাটা করত। একটু বড় গৃহস্থদের মধ্যে যারা পাট উৎপাদন করত, তারাই কেবল নগদ টাকা চোখে দেখত। কৃষিকাজ ছাড়া বিকল্প কোনো আয়ের উৎস ছিল না। এখন গ্রামে বিকল্প অনেক আয়ের উৎস সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, বছরে তিনবার ফসল উৎপাদিত হয়। রিকশা, ভ্যান-অটোরিকশা ছাড়াও অনেক ধরনের যানবাহন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বরং এসব কারণে এখন কৃষিকাজের লোকই খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেই উল্লেখ করেছি, তখন নগদ টাকার প্রচলন ছিল খুব কম, এখন যেমন একজন ভিক্ষুকের পকেটেও নগদ টাকা থাকে। আর সে সময় তা কল্পনাও করা যেত না। গ্রামে গরিব মানুষ পেটে ভাতে জন দিত। অর্থাৎ দুবেলা খাবারের বিনিময়ে তারা কৃষিকাজে শ্রম দিত। এরকম এক সামাজিক পটভূমিতে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ কতটা মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল, তা সহজেই বোঝা যায়।


এসবের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী লুটপাট ও ভারতে পাচারের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছিল। আর স্বাধীনতার পর মাত্র এক বছরের মাথায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে যায়; যা ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো। তখনকার এ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি হিসাব আমরা দেখতে পাই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অলি আহাদের লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-’৭৫ শীর্ষক গ্রন্থটিতে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এক টাকার গামছার দাম হয় সাত টাকা। ৫ টাকার শাড়ির দাম হয় ৩৫ টাকা। ৩ টাকার লুঙ্গি ১৫ টাকা বা কুড়ি টাকা, দশ আনা বা বার আনার চাউল দশ টাকা। আট আনা সেরের আটা ৬-৭ টাকা। দুই আনা সেরের কাঁচামরিচ ৪০-৫০ টাকা। তিন-চার টাকা সেরের শুকনো মরিচ ৮০-৯০ টাকা। আট আনা সেরের লবণ ৪০-৫০ টাকা। পাঁচ টাকা সেরের সরিষার তেল ৩০-৪০ টাকা। সাত টাকা সেরের নারিকেলের তেল ৩০-৪০ টাকা। এক টাকা সেরের মসুরির ডাল ৮-৯ টাকা। সাত টাকার লাঙল ৩০-৪০ টাকা। ৬ টাকার কোদাল ৩০ টাকা। ১৩৭ কিংবা দেড়শ টাকা ভরি স্বর্ণ ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। ১৫ টাকার কাফনের কাপড় ৮০-৯০ টাকা। দেড় টাকার কাঁচা সাবান ৮-৯ টাকা।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও