
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এ ধরণিকে বাসযোগ্য রাখতে বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বায়ুর গুণগতমান রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপ প্রভাব রোধ, ভূমিক্ষয় ও মরুময়তা রোধ, কার্বন সংরক্ষণ এবং কার্বন নিঃসরণ রোধসহ প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণে বন অনাদিকাল থেকে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তাছাড়া বনভিত্তিক জীবিকা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু বন উজাড় এবং অপ্রতুল সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে অনেক দেশেই বনজসম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়তই বনভূমির পরিমাণ কমছে। বিকাশমান কৃষি ও আবাসনের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। শুধু তাই নয়, নদী, খাল, জলাভূমি, জলাশয় ইত্যাদি জবরদখল ও ভরাটের কারণে প্রতিবেশের যে বিপর্যয় ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। তাই প্রতিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন আইন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনসহ এ সংক্রান্ত সব আইন ও বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ ও যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
বন সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১২ সালে ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। বনজসম্পদের গুরুত্ব তুলে ধরতে এবং নীতিনির্ধারক, গবেষক ও সাধারণ মানুষকে বনায়নের গুরুত্ব সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট একটি প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে এ দিবস পালন করা হয়। এবারও দেশে আন্তর্জাতিক বন দিবস উদযাপন করা হয়েছে। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বন বনানী সংরক্ষণ, খাদ্যের জন্য প্রয়োজন’। এ প্রতিপাদ্য বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।
বন আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। বিশ্বের বহু জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় বন থেকে প্রাপ্ত ফলমূল, বাদাম, মধু, ভেষজ উদ্ভিদ, মাশরুম ও শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কাজেই বন কেবল পুষ্টির উৎস নয়, বরং জীবনধারা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এছাড়া অনেক ঔষধি উদ্ভিদ পুষ্টি ও ভেষজ চিকিৎসার জন্যও ব্যবহৃত হয়। বন থেকে পাওয়া সব খাদ্য উপাদান মানুষকে পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি স্থানীয় জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতেও ভূমিকা রাখে। বন উজাড় হলে খাদ্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়ে। সঠিকভাবে বন সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে সহায়তা করে। বন থেকে সংগৃহীত মসলা, তেল, রজন এবং ঔষধি গাছ খাদ্য ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বনজ পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তাই বনজসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হলে খাদ্যশিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ টেকসই করতে হলে বন সংরক্ষণ ও পুনঃবনায়নের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫.৫৮ ভাগ এবং এবং বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ২২.৩৭ শতাংশ, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। দেশের প্রধান বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন, মধুপুর গড় ও শালবন উল্লেখযোগ্য। বনভূমির ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, অনিয়ন্ত্রিত বন নিধন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বনসম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ কাঠ কাটার প্রবণতা, চারাগাছের অপর্যাপ্ত রোপণ, বনাঞ্চলে অনুপ্রবেশ এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশে বন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ প্রচেষ্টা সফল হবে না। স্থানীয় জনগণ, কৃষক, বননির্ভর সম্প্রদায় এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বনের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে হবে, বন সংরক্ষণ শুধু জীববৈচিত্র্যের জন্য নয়, বরং টেকসই খাদ্য উৎপাদন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অপরিহার্য। টেকসই বন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে পরিকল্পিত নীতি প্রণয়ন এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে সামাজিক বনায়ন, বন সংরক্ষণ আইন ও বনভিত্তিক জীবিকা উন্নয়নের মতো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তবে এগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে। বন উজাড় রোধে কঠোর মনিটরিং, অবৈধ কাঠ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং বনভূমি পুনঃবনায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বন সংরক্ষণে সম্পৃক্ত করা গেলে বন ও খাদ্যের টেকসই সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হবে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষি ও বন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি, বনজ খাদ্যের চাষাবাদকে উৎসাহিত করা এবং বন ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দরকার। বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকার প্যানেল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে বন সংরক্ষণ আরও কার্যকর হবে।