ইদানীং আশাহত হয়ে পড়ছি। দেশ ও দেশের জনগণ কোন পথে হাঁটছে, তা নিজের হাঁটা দেখেও বুঝতে পারছি না। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখে বলা যায়, সবাই মিলে একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধাচরণেই এক বছর সময় কাটিয়ে দিল। সেই আগের মতোই দোষারোপের সংস্কৃতি। অথচ সেই ফ্যাসিস্ট সরকার এখন আর ক্ষমতায় নেই। তাদের অনেকেই কারাগারে, বিচারপ্রক্রিয়ায়, অনেকে আবার পলাতক। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, গুম, হত্যা, ফ্যাসিজমের কথা বলা এক বছরেও শেষ হলো না। গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছিল, বিগত এক বছরে এনসিপিসহ কয়েকটা নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গঠন ছাড়া নতুন কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না, যা দেখে জনগণ আশান্বিত হয়ে উঠতে পারে। বলা মুশকিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রকৃত বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারছে কি না। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে, যা সরকারের বিচারবুদ্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বক্তব্য প্রদানেও নেই বিচক্ষণতা। ফলে সবকিছুতে জনগণের সংশয় জেগে উঠছে।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জের ঘটনায় স্থানীয় একজন সাধারণ নারী বেশ উত্তেজিত ও আবেগাপ্লুত হয়ে জানতে চাইছিলেন, গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষ কি বাংলাদেশের নাগরিক না? গোপালগঞ্জ কি পূর্ব পাকিস্তান, যে সেটাকে স্বাধীন করতে হবে? তাঁর এমন প্রশ্ন ছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উদ্দেশ করে। এমন একজন গ্রামের সাধারণ নারীর প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠার মতো ব্যাপার। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েকবার তাঁর অভিযোগ, অভিমান লক্ষ করলাম। কানে বাজল। কোলে শিশুসন্তান নিয়ে তাঁর এই জানতে চাওয়া! তিনি আরও বলছিলেন, গোপালগঞ্জে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। বুলেটের নিচে পিষে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলে মারধর করা হচ্ছে। কিন্তু কেন? লক্ষ করা গেছে যারা এনসিপির রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরোধিতা করেছে গোপালগঞ্জে তারা বয়সে তরুণ। একটা পর্যায়ে এনসিপি নেতাদের তারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার বেষ্টনী দিয়ে এনসিপির নেতাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হলো। এমন একটা ঘটনা ২৪-এর জুলাইয়ে তাঁদের যে অর্জিত ভাবমূর্তি, সেটাকে ক্ষুণ্ন করে কি না, তা তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন। তাঁরা রাজনৈতিক সংগঠন করেছেন নির্বাচনে গিয়ে জনপ্রতিনিধি রূপে ক্ষমতায় বসে দেশ শাসন করবার অভিপ্রায়ে। জনগণের কাছে পৌঁছাবার জন্য তাঁদের আস্থা অর্জন করতে হবে এবং সেটা কথায় ও কাজে।
সত্যি গোপালগঞ্জ তো পূর্ব পাকিস্তান নয় যে সেটাকে স্বাধীন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে এবং সেটা সদ্য গঠিত একটি রাজনৈতিক দল এনসিপিকে নিরাপত্তা দেওয়ার অভিপ্রায়ে। গোপালগঞ্জ নিয়ে এনসিপিরই-বা এত অ্যালার্জি, ক্ষোভ কেন? উত্তর কিন্তু এনসিপির আচরণেই প্রকাশ পায়। গোপালগঞ্জ হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে যাঁর অবদান, ভূমিকা এবং নেতৃত্ব ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে—এমন দাবির মানুষ কিন্তু কম নয়। এই ব্যক্তিসত্তা গোপালগঞ্জবাসীর গর্ব। অন্য কেউ তাঁকে স্মরণ করুক, শ্রদ্ধা করুক আর নাই করুক, গোপালগঞ্জবাসী কিন্তু সারা জীবন তাঁকে মনে রাখবে, মনে ধারণ করবে। গোপালগঞ্জ গিয়ে এনসিপির এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত হয়নি, যেটা গোপালগঞ্জবাসীকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে, উত্তেজিত করবার আশঙ্কা থেকে যায়, এমন অভিমত অনেকেই প্রকাশ করেছেন ঘটনা ঘটার পর। সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য তাদের বক্তব্যকে দায়ী করেন তাঁরা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের পদযাত্রার অভিব্যক্তি ছিল একরকম, আর গোপালগঞ্জে দেখা গেছে আরেকরকম, এমনও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। এনসিপির সভা থেকে আরও উচ্চারিত হলো, শুধু গোপালগঞ্জ নয়, বগুড়া, রংপুর, ফেনী কোনো অঞ্চলকে আর কারোর হতে দেওয়া হবে না। বোঝা যায়, বিগত সরকার ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতাদের প্রতি তাদের যথেষ্ট রাগ, ক্ষোভ রয়েছে। কারণ স্পষ্ট, উল্লিখিত অঞ্চলগুলো রাজনৈতিক দলের ও সরকারপ্রধানদের জন্মস্থান। এটা বলা অপরিহার্য যে, নিজস্ব এলাকায় থেকেই শুরু হয় নেতাদের রাজনৈতিক প্রচারণা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যার প্রতিফলন ঘটে এবং এভাবেই জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠেন তাঁরা। আর এনসিপির নেতারা ভুলে যাচ্ছেন কেন যে, তাঁদের নিজেদেরও জন্মস্থান রয়েছে এবং যেখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন, স্থানীয়রা তাঁদেরকে মনেপ্রাণে ধারণ করবে, যদি তাঁরা দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে সমর্থ হন।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, এনসিপিকে সরকারের এতটা সুরক্ষিত রাখা বা নিরাপত্তা দেওয়ার কারণ কী? বোকার মতো প্রশ্ন বটে। কারণ, এই প্রশ্নের জবাব সবার হাতে নগদে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগদাতা এরাই। ফলে এদের সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা দিতে এই সরকার বাধ্য। বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা নতুন বাংলাদেশ গড়বার প্রত্যয় ছিল। যদিও সেটা ধীরে ধীরে বিগত রাজনৈতিক সরকার আমলের ঘটনার পুনরাবৃত্তির রূপ নিয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চেতনা, চাঁদাবাজি, তদবির, ঘুষ, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অতীতের মতো বর্তমানেও অহরহ ঘটছে। কেউ কেউ মনে করছে, সময়সীমা বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ জনগণ ভেবেছিল, একটা ইতিবাচক পরিবর্তন তারা দেখতে পারবে হয়তোবা। কিন্তু সেই আশাটা এখন অনেকেই করছে না। আশা করবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের অভিমত, ক্ষমতার মোহ ব্যক্তির অবস্থান, আচরণ বদলে দেয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাধারণ ছাত্রদের এক অংশের আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে যে, মুষ্টিমেয় কিছু নেতা তাদেরকে ব্যবহার করে আজ সামনের কাতারে এবং সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। বলা বাহুল্য যে, অনেকেই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। উল্লেখ্য, সাধারণ জনগণ, যারা বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিল তারাও যেন আজ আশাহত।