‘মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণি’-অ্যারিস্টোটল
আব্দুল আহাদ-মাত্র চার বছরের এক শিশু। তার বাবা-মার সঙ্গে থাকত ঢাকার রায়েরবাগে। গত বছর ১৯ জুলাই সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়। রিয়া গোপ নামের ছয় বছরের আরেক শিশু ঢাকায় নিহত হয় ছাদে খেলা করার সময়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া কিলিং স্কোয়াড তাকে হত্যা করে।
চার থেকে সতেরো বছরের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোরদের অন্তত ৬৬ জনের তালিকা নিশ্চিত করা যায় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের উদ্ঘাটিত তথ্যানুযায়ী আন্দোলনে নিহত প্রায় এক হাজার চারশর মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হলো শিশু-কিশোর। অন্য কয়েকটি সূত্রমতে ১৮ বছরের নিচে নিহতের সংখ্যা হবে ১৮০ জনের মতো।
আহাদের মতো একজন অবলা শিশু কি জানত তার কী অপরাধ? একটা রাষ্ট্র একুশ শতকের পৃথিবীতে কেন তার মতো একটি শিশুকে গুলি করে হত্যা করল? কেন রিয়া গোপের প্রাণ কেড়ে নিতে হলো একটি রাষ্ট্রকে, যে কিনা জানতই না রাষ্ট্র কী। যারা এ শিশুদের হত্যা করেছে, তারা কি দেখেনি ওরা শিশু? গুলি করার সময় ওদের হাত কি একটুও কাঁপেনি? শুধু নিজ পছন্দের একটি অনির্বাচিত সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য ছোট্ট শিশুদের হত্যা করে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের বিবেক মোটেও নিজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেনি।
কেন এমন ভয়াবহ স্যাডিস্ট মানসিকতার জন্ম হয়েছিল দেশের প্রতিটি বাহিনীর মধ্যে? প্রশাসনের মধ্যে? সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়াই হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজমের শিকড় অনুসন্ধানের প্রকরণ।
এদিকে, সম্প্রতি বিবিসি গত ৮ জুলাই তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া অডিও থেকে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গত বছর আন্দোলনকারীদের ভয়াবহ কায়দায় দমনের নির্দেশ দেন। এখন বিশ্ব জানে তরুণ-যুবকদের সংগঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে কীভাবে জনতা যোগদান করেছিল আর কত নিরীহ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি র্যাবের মতো বাহিনী তাদের হেলিকপ্টার দিয়ে রাত দিন স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে, গুলি করে মানুষ ও শিশুদের হত্যা করেছে। স্নাইপার রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষিত স্নাইপাররা বিভিন্ন ভবনে অবস্থান নিয়ে টার্গেট করে করে তরুণ-তরুণীদের হত্যা করেছে। ভাবা যায়?
ওই স্নাইপাররা ছিল তদানীন্তন সরকারের গুণমুগ্ধ ক্যাডারবিশেষ। তারা দেখল, যদি আওয়ামী লীগ সরকার না থাকে, তাহলে তারা অন্যায়ভাবে যেসব সুবিধাদি নিয়ে থাকে, সেসব আর থাকবে না। তাই নিজ জাতির বিরুদ্ধেই তারা দাঁড়িয়ে গেল। গুলি করে হত্যা করল শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতীদের। এটাই ঘটেছিল তখন বাংলাদেশে। এ যেন ছিল কুখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যের শাসক ক্যালিগুলা বা মঙ্গোল হালাকু খানের শাসনের মতো এক অবিশ্বাস্য ক্রূরতায় ভরা মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নয়, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সরকারি প্রশাসন-সশস্ত্র বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের নামে এক রামরাজত্ব ও বিভীষিকাময় পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। প্রায় এক কোটি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামে মামলার পর মামলা দেওয়া হয়েছে। সে সময় হাজার হাজার মানুষকে কিডন্যাপ করা হয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। অসংখ্য মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। জঙ্গি তকমা দিয়ে যাকে-তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, নিরেট রাজনৈতিক কর্মীকে ভয়াবহ জঙ্গির তালিকায় ফেলা হয়।