
অপরাধ দমনে সিপিটিইডি মডেল যেভাবে কার্যকর
বর্তমান বিশ্বে অপরাধ বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা। আর এই সমস্যা কখনো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন কিংবা সাইবার অপরাধের রূপে প্রকাশ পায়, আবার কখনো শিশু বা নারী নির্যাতন কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজকে অস্থির করে তোলে।
এমনকি এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অপরাধ মানবসভ্যতার সাথে দীর্ঘদিন ধরে সহাবস্থান করছে। কোথাও এটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সহিংসতা, কোথাও সংগঠিত অপরাধ, আবার কোথাও প্রযুক্তিনির্ভর সাইবার অপরাধের রূপে প্রকাশ পায়। অপরাধ দমন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা অসংখ্য তত্ত্ব ও মডেল উপস্থাপন করেছেন, যা শুধু আইন প্রয়োগ নয় বরং অপরাধের উৎস ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সাহায্য করে।
উন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশ পর্যন্ত কোথাও অপরাধের হার তুলনামূলক কম, কোথাও বা অনেক বেশি। তবে কম হোক কিংবা বেশি হোক, অপরাধ দমন বা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিকভাবে বেশকিছু স্ট্যান্ডার্ড মডিউল অনুসরণ করা হয়।
তার মধ্যে কয়েকটি কার্যকারিতার ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। আর এই প্রমাণিত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে তুলে ধরা যায় CPTED (Crime Prevention Through Environmental Design) মডেলকে। এই মডেলটি বিভিন্ন কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি শুধু আইন প্রয়োগ বা পুলিশি টহল নয় বরং নগর নকশা, সামাজিক অংশগ্রহণ, জনসচেতনতা এবং স্থাপত্য কাঠামোকে একত্রিত করে অপরাধ প্রবণতা কমায়।
CPTED-এর মূল দর্শন হলো এমনভাবে শহর বা আবাসিক এলাকা ডিজাইন ও পরিচালনা করা যাতে অপরাধী মানসিকভাবে নিরুৎসাহিত হয়। এমনকি স্বাভাবিক জনজীবনের দৃষ্টিসীমা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় অধিবাসীরা নিরাপত্তার জন্য স্বস্তিকর অনুভূতি পান।
CPTED-এর চারটি প্রধান উপাদান আছে। একটি হলো টেরিটোরিয়াল রক্ষণাবেক্ষণ, যেখানে প্রতিটি স্থাপনার সীমানা ও পরিচ্ছন্নতা মালিকানার বোধ সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ, যেখানে রাস্তা, গলি, জানালা ও গেটের অবস্থান এমন থাকে যাতে স্বাভাবিকভাবেই সবার নজরে স্থানটি থাকে।
প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, যা অচেনা বা অননুমোদিত প্রবেশকে কঠিন করে তোলে এবং রক্ষণাবেক্ষণ বা মেইনটেন্যান্স, যা ভাঙা, অন্ধকারাচ্ছন্ন বা পরিত্যক্ত স্থানকে অপরাধের আখড়া হতে বাধা দেয়। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের Secured by Design (SBD) প্রোগ্রামটি উল্লেখযোগ্য, যা ১৯৮৯ সাল থেকে চালু রয়েছে এবং নতুন আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা ডিজাইনের সময় এমন সমস্ত নিরাপত্তা ও দৃশ্যমানতার শর্ত আরোপ করে চুরির হার প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এখানে ভবনের জানালা, আলোকসজ্জা, রাস্তা ও পার্কিং স্পেসের অবস্থান এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয় যাতে স্বাভাবিকভাবেই নজরদারি থাকে এবং সন্দেহজনক প্রবেশপথ বন্ধ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে Chicago Alternative Policing Strategy (CAPS) ১৯৯৩ সাল থেকে কমিউনিটি পুলিশিং মডেল হিসেবে কাজ করছে, যেখানে পুলিশ ও সাধারণ মানুষ মাসিক মিটিং করে এলাকাভিত্তিক অপরাধের ধরন চিহ্নিত করে এবং ডিজাইন, আলো, পথনির্দেশ, সামাজিক কর্মসূচি ও স্থানীয় নজরদারি একত্রিত করে অপরাধের মূল কারণ সমাধানে মনোযোগ দেয়।
অপরদিকে উত্তর ইউরোপের উদাহরণে আইসল্যান্ডের Barnahus মডেল শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে CPTED দর্শনের একটি সামাজিক সংস্করণ, যেখানে শিশুদের জন্য বিশেষ ডিজাইনকৃত ভবনে পুলিশ, চিকিৎসক, সামাজিক কর্মী ও বিচারক একসাথে কাজ করে যাতে শিশু পুনরায় ট্রমা ছাড়া ন্যায়বিচার পায়।
Barnahus মডেল মূলত শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও বিচার প্রক্রিয়ার একটি সমন্বিত মডেল, যা প্রথম চালু হয় আইসল্যান্ডে ১৯৯৮ সালে। ‘Barnahus’ শব্দটির অর্থ আইসল্যান্ডিক ভাষায় “Children’s House” বা শিশুদের ঘর। এটি এমন একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান যেখানে শিশু নির্যাতনের শিকার শিশুরা (যেমন শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন বা মানসিক নির্যাতন) এক জায়গায় সব ধরনের সহায়তা ও ন্যায়বিচার পায়, যাতে তারা বারবার জিজ্ঞাসাবাদ বা বিচার প্রক্রিয়ায় ট্রমার শিকার না হয়।