
খায়রুল হককে জবাব দিতে হবে
গত ৩০ জুলাই দুর্নীতিমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ এবং বেআইনি রায় প্রদানসহ জাল-জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ থানায় করা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বেআইনি রায় প্রদান ও জাল রায় তৈরির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের একটি মামলায়ও খায়রুল হককে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বিলম্বে হলেও সরকার সঠিক জায়গায় হাত দিয়েছে। খায়রুল হক এ জালিয়াতির রায়ে একদিকে যেমন সর্বোচ্চ আদালতকে কলঙ্কিত করেছেন, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার পথকে সুগম করেছেন। বিষয়টি বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে ১৫ বছর ৩ মাস আগে।
২০১০ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ খায়রুল হকের নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। বাতিল রায়ের সময় সুপ্রিমকোর্টের সাত বিচারপতির ফুল বেঞ্চ রায় দেন। প্রথমে পক্ষে ছিলেন তিনজন বিচারপতি। তারা হলেন বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি মাহমুদ হোসেন। বিপক্ষেও তিনজন ছিলেন। তারা হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এবং বিচারপতি ইমান আলী। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি হিসাবে খায়রুল হক রায়ের পক্ষে অবস্থান নিলে চার-তিন, অর্থাৎ পক্ষে চারজন এবং বিপক্ষে তিনজন অবস্থান নেন। এভাবে কেয়ারটেকার সরকার বাতিল হয়। খায়রুল হক ছাড়া আর যে তিনজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের পক্ষে রায় দেন, তাদের সবাইকে এক এক করে প্রধান বিচারপতি বানিয়ে শেখ হাসিনা ইনাম দিয়েছেন।
এ রায় লেখা নিয়ে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি করেন খায়রুল হক, যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রতারণা ও জালিয়াতি হিসাবে চিহ্নিত থাকবে।
কেয়ারটেকার সরকার বাতিলের ক্ষেত্রে সব সময়ের মতো প্রথমে সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়া হয়। এই রায়ে বলা হয়, কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করা হলো। তবে পরবর্তী দুটি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে। সুতরাং সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হবে। এর পরেই সেই মহাজালিয়াতি হয়।
সংক্ষিপ্ত রায়ের পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কথা। এ ধরনের অতীব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কিত রায় প্রধান বিচারপতিই লিখে থাকেন। এক্ষেত্রেও খায়রুল হকই রায় লেখার দায়িত্ব নেন। জাস্টিস খায়রুল হক অবসর গ্রহণ করেন ২০১১ সালের ১৭ মে। অথচ তিনি পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় দাখিল করেন ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ অবসর গ্রহণ করার ১৬ মাস পর তিনি এ রায় দাখিল করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, অবসর গ্রহণের পর কোনো বিচারপতি আইনগতভাবে কোনো রায় লিখতে পারেন না। তবে অনেক সময় বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের পর দুই-তিন মাস পর্যন্ত রায় লেখা যেতেও পারে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার ১৬ মাস পর কোনো অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে পারেন না।
একে তো খায়রুল হক অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পর রায় জমা দেন। তার পরেও এ পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি আরেকটি জালিয়াতি করেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল, পরবর্তী দুটি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ অংশটি তিনি বাদ দেন। অর্থাৎ পরবর্তী দুটি নির্বাচন যে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে, এ অংশ তিনি বাদ দেন। ফলে রায়টি শুধু এই হয় যে, কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করা হলো।
এত বড় জালিয়াতি পৃথিবীর কোনো বিচার বিভাগে হয়নি। সুপ্রিমকোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেখানে জাস্টিস খায়রুল হকের এ অপকর্ম রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে। তাই বিএনপির মহাসচিব যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে খায়রুল হকের বিচার হওয়া উচিত।
এ রায়ের ফলে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ উন্মোচিত হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থি। তাই সেটি বাতিল করা হলো।