
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না?
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম দেখে হয়তো আপনারও চোখ ছানাবড়া হয়েছে। আজ শুক্রবার, ২১ মার্চ, ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার’— এই শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ বা এমপিএ) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না। তাদের পরিচয় হতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। বিদ্যমান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধনের চূড়ান্ত খসড়ায় এ প্রস্তাব করা হয়েছে। (সমকাল, ২১ মার্চ ২০২৫)।
এই খবরের অর্থ কি এই যে, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মতো নেতারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? তাদেরকে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ বলার মধ্য দিয়ে কি তাদের সম্মান বাড়ানো হচ্ছে নাকি অসম্মানিত করা হচ্ছে? দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরে এই অসম্মান কি তাদের প্রাপ্য? এর মধ্য দিয়ে কি জাতি হিসেবে আমরা নিজেদেরকে খুব মহিমান্বিত করছি? যারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য কী? মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান ও নতুন ইতিহাস তৈরি করা?
অন্তর্বর্তী সরকার, যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতি সচল রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকারে হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই যাদের প্রধান কাজ—তারা ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত এমন একটি বিষয় নিয়ে কেন বিতর্ক উসকে দিচ্ছে? এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে আরও বেশি বিভাজন ও বিশঙ্খলা তৈরি হলে কার লাভ? নানারকম অস্থিতিশীলতা তৈরি করে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করাই কি আসল উদ্দেশ্য? অন্তর্বর্তী সরকার যখন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে এবং যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলছে—সেই সময়ে ১৯৭১ তথা মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে এরকম একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সরকার কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে, যাতে করে তাদের ঐক্য ও সংস্কারের আলাপগুলোই অর্থহীন হয়ে পড়ে?
মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি
মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়ে যাবে, সেটি ছিল অবধারিত। কেননা মাঝখানের ভারতের মধ্যে একটি বিরাট রাষ্ট্র থেকে দুই প্রান্ত মিলিয়ে একটি অভিন্ন দেশ যে পৃথিবীর রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসে একটি উদ্ভট আইডিয়া— সেটি যেকোনো সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যেকোনো মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন। সুতরাং বাংলাদেশ আলাদা বা স্বাধীন হতোই। সেটি ১৯৭১ সালেই হোক, কিংবা আরও ১০ বছর পরে।
বাংলাদেশ যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে— তার পেছনে এই ভৌগোলিক সংকট এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানাবিধ শোষণ-বঞ্চনার বাইরেও দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত নানা পার্থক্যও কারণ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। ফলে আজ হোক কাল হোক, পাকিস্তানের দুই অংশের আলাদা হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। আরও স্পষ্ট করে বললে, এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালেই। তারপর ধীরে ধীরে, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন, নির্বাচনের পরে পশ্চিম পাকিস্তানের টালবাহনা এবং সবশেষে গণহত্যা চাপিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে যুদ্ধের মাঠে নিয়ে আসা— প্রত্যেকটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চাশের দশক থেকে এর প্রতিটি ধাপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন যে মানুষটি; যিনি এই ভূখণ্ডে মানুষের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন এবং ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে গেছেন— তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। দলমত নির্বিশেষে কানো বাঙালির পক্ষে এই সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ডাক দেয়া মানুষটির নামও শেখ মুজিবুর রহমান। ওই ভাষণটি অন্য কেউ দেননি। ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দেশের লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের লেখায় নয়, বরং অনেক খ্যাতিমান বিদেশি সাংবাদিক এমনকি পাকিস্তানের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও লেখকদের লেখায়ও এটা স্পষ্ট যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মূলত বঙ্গবন্ধুর নামেই।