বাংলা একাডেমি ও পুরস্কার সমাচার
পুরস্কার ঘোষণা, স্থগিত ও প্রদানবিষয়ক এক মজার রম্য-নাটক মঞ্চস্থ হলো সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। নাটকীয়তার ঘটনাস্থল বাংলা একাডেমি। একুশে উপলক্ষ্যে জানুয়ারির শেষদিকে প্রতিষ্ঠানটি যথারীতি পুরস্কার ঘোষণা করে। ঘোষণার পরপরই নিন্দা ও প্রতিবাদের তোড়ে পুরস্কার স্থগিত করা হয়। অবশেষে প্রথমে ঘোষিত তালিকার কাউকে কাউকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য রাখা হয় এবং কাউকে কাউকে পুরস্কারের খাতা থেকে নাম কেটে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রথম তালিকায় ঘোষিতদের মধ্যে আংশিক পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষমাণ আর আংশিক বঞ্চিত। এরূপ ঘটনাবলির মধ্যে রঙ্গরস যেমন আছে, বহু প্রশ্নও আছে।
একদিকে, পুরস্কার ঘোষণা করে ফিরিয়ে নেওয়া নিশ্চয় খুব ভালো কাজ নয়। অন্যদিকে, পুরস্কার ঘোষণার পর স্থগিত করে কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে দেওয়াও শোভন নয়। এতে ঘোষিত হওয়ার পর স্থগিত থেকে ফের পুরস্কারপ্রাপ্ত হওয়া এবং ঘোষণা ও স্থগিতের ধাক্কাধাক্কিতে পুরস্কারবঞ্চিত হওয়া, এ উভয় শ্রেণির মধ্যে কে সম্মানিত হলেন আর কে অপমানিত হলেন, তা গবেষণার বিষয় বৈকি! আর পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির দক্ষতা, যোগ্যতা সম্পর্কেও একটা ধারণা স্পষ্ট হয়েছে মানুষের মধ্যে। সেটা হলো এই যে, আগে বাংলা একাডেমি সমালোচিত হয়েছে সরকারের তোষণ ও পক্ষপাতের মাধ্যমে পুরস্কার দেওয়ার জন্য। এবার পুরস্কার প্রদান, স্থগিত ও আবারও প্রদানবিষয়ক নাটক দেখিয়ে সবার হাসির পাত্র হলো। ‘সমালোচিত হওয়া’ ও ‘হাসির পাত্র’ হওয়ার মধ্যে সম্মানের উপাদান কত কম আর অপমানের উপাদান কত বেশি, সেটি জানার জন্য নিশ্চয় গবেষণার প্রয়োজন হয় না।
আদপে রাজনৈতিক পদলেহন, আমলাতান্ত্রিকতা, লেজুড়বৃত্তি ও বশংবদ মানসিকতার জন্য প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কারের পতন ও অবক্ষয় হয়েছে চোখে পড়ার মতো। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকার চেয়ে পুরস্কার না পাওয়াদের তালিকায় থাকা নামগুলোই যখন উজ্জ্বল দেখায়, তখন পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াই বরং সম্মানের। পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রবর্তিত হয় ১৯৫৫ সালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাননি। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র লেখকের তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি অভিন্ন। যে স্বীকৃতি পৌঁছুতে পারেনি আহমদ ছফা বা শহীদুল জহিরের কাছে, তার খুব একটা মান ও গুরুত্ব আছে কিনা, সেটাই বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়। এক্ষেত্রে অধিক আলোচনা অর্থহীন। তবে, একটি বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির পর প্রথা, প্রতিষ্ঠান, পুরস্কার সম্পর্কে এক আশার জায়গা তৈরি হয়েছিল বটে। সে আশায় আপাতত গুড়ে বালি।
আশাহত হওয়া যদিও বেদনার, তথাপি জাতিগতভাবে আশাভঙ্গ হওয়াই যেন আমাদের নিয়তি। বিশেষত রাজনৈতিক আশা ভেঙেছে অনেকবার। সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের স্বপ্ন বিচূর্ণ হয়েছে বারবার। যার মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক সুশাসনের প্রত্যাশা। তুলনায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আশাও দুরাশায় পরিণত হয়েছে অনেকবার। এজন্যই নানা ভেকধারীর আগ্রাসন ও আধিপত্য সহ্য করতে হয়েছে মানুষকে।
জুলাই-আগস্ট (২০২৪) পরিবর্তনের ফলে আবারও একটি আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গঠিত সরকার গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের সরকারগুলোর মতো নয়। তারা দলীয় সরকার নয় বলে তাদের সামনে দলীয় মতাদর্শভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা এখন পর্যন্ত নেই। তাদের ঘোষিত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা এবং অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার যতদূর সম্ভব অবসান ঘটানো। বাংলা একাডেমি সরকারের মূল লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে এবং গোত্র ও গ্রুপের পক্ষপাত ও বৈষম্যের বাইরে বের হতে পারেনি। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে, বাংলা একাডেমির আমূল সংস্কার, পুরস্কার কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের শাস্তিসহ চার দফা দাবিতে প্রতিষ্ঠানটি ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ‘বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ’, ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ ও ‘জুলাই রাজপথ’ নামের তিনটি প্ল্যাটফর্ম এ কর্মসূচি পালন করে। পরে একাডেমির মহাপরিচালকের হাতে দাবিগুলো তুলে দিয়ে মেনে নেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
কর্মসূচিতে উত্থাপিত বক্তব্যগুলো প্রণিধানযোগ্য। আমলাতান্ত্রিক কর্তাদের কানে এসব কথা ঢুকবে বলে মনে হয় না। কারণ, বক্তারা বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বাংলা একাডেমিতে প্রথম আলো গংয়ের মহাপরিচালক রেখে কোনো সংস্কার সম্ভব নয়। কারণ তিনি খুনি হাসিনা ও ফ্যাসিস্টের সহযোগীদের বিতাড়িত না করে উলটো পুনর্বাসন করছেন। এমনকি তাদের দিয়ে পুরস্কার নির্বাচন ও বাছাই করায় বাংলা একাডেমির সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাহিত্য পুরস্কার
- বাংলা একাডেমি