অধ্যাপক আনিসুর রহমান ‘দারিদ্র্য নিরসন’ কথাটায় বিশ্বাস করতেন না

বণিক বার্তা ড. মইনুল ইসলাম প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫২

আমার শিক্ষক, শিক্ষাগুরু ও পথপ্রদর্শক অধ্যাপক আনিসুর রহমান ৫ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৯৭২ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের শেষ বর্ষের ছাত্র তখন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমান তার কমিশনের কর্মপরিধি কিছুটা কমিয়ে আমাদের ‘মাইক্রো-ইকোনমিকস’ কোর্সটি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। (যদিও ১৯৭১ সালে আমার এমএ পাস করার কথা ছিল, কিন্তু ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমরা প্রায় দেড় বছর সেশন বিলম্বের শিকার হয়েছিলাম)। ওটা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে সেরা অর্জন, সেশন বিলম্ব না হলে আমি আমার শিক্ষাজীবনের সেরা শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুর রহমানের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতাম। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেই ১৯৭২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন আমার ‘ফিলোসফার-গাইড’ ও সার্বক্ষণিক শিক্ষাগুরু, সারা জীবন আমি তাকেই অনুসরণ করার সর্বাত্মক প্রয়াস অক্ষুণ্ন রেখেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম বিভাগে প্রথম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি অধ্যাপক আনিসুর রহমান একাডেমিক্যালি ছিলেন মেধাবী, কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন একজন ‘অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি-দার্শনিক’, যার তুলনীয় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি অধ্যাপক আনিসুর রহমানের দর্শনকেই ফোকাস করতে চাই।


অধ্যাপক আনিসুর রহমান কখনই ‘দরিদ্র’ ও ‘দারিদ্র্য নিরসন’ কথা দুটো ব্যবহার করতেন না। সমাজের প্রান্তিক অবস্থানের জনগণকে তিনি সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী আখ্যায়িত করতেন। কারণ তার দার্শনিক অবস্থান ছিল—একটি দেশে বিদ্যমান ‘সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির সিস্টেম’ সার্বক্ষণিকভাবে দারিদ্র্য সৃষ্টি এবং পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। এ ‘সিস্টেম’ পরিবর্তন করাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে মোকাবেলা না করলে শুধু ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ কিংবা ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ দিয়ে কখনই টেকসইভাবে দারিদ্র্যকে মোকাবেলা করা যাবে না। ২০০৭ সালে প্রকাশিত তার একটি প্রবন্ধ ‘‌Poverty, Overcoming Poverty and Self-Realization’-এ দেয়া তার একটি স্মরণীয় উক্তির বাংলা অনুবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে এ সম্পর্কে তার অবস্থানটি তুলে ধরছি, ‘যতদিন এভাবে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে ততদিন দারিদ্র্যকবলিত গোষ্ঠীর আয়কে ধাপে ধাপে বাড়ানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানোর প্রয়াসগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে হয়ে দাঁড়াবে একটি নিচের দিকে চলমান এসকেলেটর ব্যবহার করে ওপরে ওঠার মতো কঠিন কাজ। এ রকম প্রয়াস সিস্টেম থেকে কখনই দারিদ্র্যকে নির্মূল করতে পারবে না, যদি ওই এসকেলেটরের নিম্নগামী পতনকে (ডাউনওয়ার্ড গ্লাইড) সুইস অফ করে বন্ধ না করা হয়। এ সুইস অফ করার ব্যাপারটি হলো সমাজের কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পদ ও সামাজিক ক্ষমতার পুনর্বণ্টনের লক্ষ্য অর্জন’।



মানুষকে মাইক্রো-ক্রেডিট কিংবা এনজিও ঋণ সহায়তার ‘টার্গেট’ হিসেবে বিবেচনা করে দারিদ্র্য নিরসন করতে চাইলে সেটা মনুষ্যত্বকে অপমান করার শামিল হবে। আনিসুর রহমান মনে করতেন, বিশ্বব্যাংক অনুসৃত মাথাপিছু জিডিপির মাধ্যমে কিংবা দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাপক দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ করার মানে হলো মানুষকে গরু-ছাগলের পর্যায়ে নামিয়ে আনা। তিনি ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর অনুপাতকে’ বলতেন ‘লাইভস্টক কনসেপ্ট অব পোভার্টি’। এ ধরনের কনসেপ্টগুলো যে বাংলাদেশের জনগণকে অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে লুণ্ঠনের ব্যাপারটিকে শাসক মহল কর্তৃক লুকিয়ে ফেলার জন্য অপব্যবহার করা হয়েছে, পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পর সে ব্যাপারটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্টভাবে উদ্ঘাটিত হয়ে চলেছে। গত সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয়ভাবে বাড়ছে মর্মে ‘ডাটা ডক্টরিংয়ের’ মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচারড (ভুয়া) পরিসংখ্যান প্রতি বছর সৃষ্টি করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে আমার রচিত ও ২০০৯ সালে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ (রিইব) কর্তৃক প্রকাশিত দ্য পোভার্টি ডিসকোর্স অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থের মূল বক্তব্যটি এ দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধারণ করে রয়েছে। আনিসুর রহমান যখন আফ্রিকার তানজানিয়ায় তার গণগবেষণার মাঠ পর্যায়ের প্রয়োগ চালাচ্ছিলেন তখন একজন কৃষক বলেছিলেন, ‘আমাদের ‘পুওর’ না বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ’।



অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও ড. মাহবুবুল হকের মানব উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি মাথাপিছু জিডিপির সংকীর্ণ কনসেপ্ট থেকে দারিদ্র্য ডিসকোর্সকে কিছুটা মুক্ত করলেও আরো অনেক কিছু বিবেচনা থেকে এখনো বাদ রয়ে গেছে। উন্নয়নে অমর্ত্য সেনের ‘এনটাইটেলমেন্ট’ ও ‘ক্যাপাবিলিটি’ ধারণাগুলোকে আনিসুর রহমান সমর্থনযোগ্য মনে করলেও তিনি ওখানে থামতে নারাজ। তিনি উন্নয়নকে বিবেচনা করেন ‘মানুষের সৃজনশীল শক্তির স্বাধীনতা অর্জন’ (লিবারেশন অব পিপল’স ক্রিয়েটিভ এনার্জি), যেখানে আত্মবিকাশের অদম্য ইচ্ছা (আর্জ ফর সেলফ-রিয়ালাইজেশন) প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করে এমন ইচ্ছাপূরণ সম্ভব না-ও হতে পারে। সমাজে বিদ্যমান বহু ধরনের বঞ্চনা ও গ্লানি নিরসন এমন আত্মবিকাশের অংশ হতে পারে। মানুষের বঞ্চনার মাত্রায় সব সময় অর্থনৈতিক বঞ্চনাই যে শীর্ষস্থানে থাকবে সেটা না-ও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে একজন হরিজনের অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের চেয়ে সামাজিক সমমর্যাদা অর্জনের লড়াইয়ের অগ্রাধিকারকে উল্লেখ করা যায়। অথবা একটি ইউরোপীয় উপনিবেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যটি জনগণের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়াই স্বাভাবিক। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে রাষ্ট্র ও বাজারের তুলনামূলক ভূমিকা চয়নের পাশাপাশি কমিউনিটি ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীগত প্রয়াসকেও আনিসুর রহমান সমভাবে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। সারা বিশ্বে ‘পার্টিসিপেটরি একশন রিসার্চের’ তিনজন আগুয়ান চিন্তানায়কদের (পাওনিয়ার) মধ্যে আনিসুর রহমান ছিলেন একজন। অন্য দুজন ছিলেন ব্রিটেনের পিটার চ্যাম্বার্স ও কলম্বিয়ার অরল্যান্ডো ফল্স-বোর্দা। আনিসুর রহমান পার্টিসিপেটরি একশন রিসার্চের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘গণগবেষণা’। এর মূল কথা হলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিজেরাই নিজেদের গণগবেষণার মাধ্যমে তাদের বঞ্চনা ও সুবিধাহীনতার কারণ বের করতে হবে। সরকার কিংবা কোনো এনজিওর প্রতিনিধি তাদের প্রতিনিধি হয়ে এ বঞ্চনার কারণ উদ্ঘাটন করে দেবে না। বাইরের কেউ ভূমিকা রাখতে চাইলে সাময়িকভাবে শুধু ‘উদ্দীপক’ (এনিমেটর) কিংবা ‘অসুবিধা-লাঘবকারী’র (ফ্যাসিলিটেটর) ভূমিকায় থাকতে পারে। সেজন্য তিনি পাড়ার সবাইকে মাসে অন্তত দুবার ওঠোন বৈঠকে মিলিত হয়ে গণগবেষণার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যার কারণ বের করা এবং সম্ভাব্য সমাধান ঠিক করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। 

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও