যুদ্ধাহতের ভাষ্য-১১৭: ‘মরণের পরে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান আমার দরকার নাই’
“সময়টা ১৯৬৩ সাল। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে আমরা রেজাল্টের অপেক্ষায়। আব্বা তখন বুক বাইন্ডার। চাকরি করতেন ঢাকার বাংলাবাজারে। থাকতেন নওয়াব বাড়িতে। আমি ওইসময় বেড়াতে যাই আব্বার কাছে। সঙ্গে ছিলেন দূরসম্পর্কের এক ভাই তালুকদার মজনু।
ঢাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। একদিন পরিচিত একজনের মুখে শুনি আর্মিতে লোক নেওয়ার সংবাদটি। ‘কাল আর্মিতে লোক ভর্তি করবে, যাবি তোরা’— আমরা রাজি হতেই জানিয়ে দেন ঠিকানাটি। ওইদিন সকালেই আমি আর মজনু রওনা দিই পলাশী ব্যারাকের দিকে। ওখানেই লাইন দিচ্ছিল সবাই।
আমরাসহ লাইনে ছিল পঞ্চাশ থেকে ষাট জন। এক সুবেদার বাছাই করছিলেন। আমাকে না নিয়ে তিনি আগে-পিছে অন্যদের নিয়ে নিচ্ছেন। নজরে পড়তে আমি আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এবারও আমাকে না নিয়ে অন্যদের নেওয়া হলো। আগের মতোই আবার লাইনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন সুবেদার বললেন, ‘কেন বারবার সামনে আসছ। তুমি বাচ্চা ছেলে, তোমাকে নেওয়া যাবে না।’
খুব রাগ হলো। আমি কইলাম, ‘আপনিও তো আমারই সমান। খাওয়া দাওয়া করেছেন বলে একটু মোটা হইছেন। কিন্তু আপনার হাইট তো আমার মতোই।’ আমার কথা শুনে তিনি হেসে দিলেন। দূরে বসে ঘটনাটি দেখছিলেন রিক্রুটিং অফিসার। আমাকে ডেকে তিনি বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করে বললেন, আর্মিতে কেন ভর্তি হতে চাও?
উত্তরে বললাম, ‘স্যার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিছি, রেজাল্ট হয় নাই। ওয়েস্ট পাকিস্তান দেখার খুব শখ।’ আমার কথা শুনে তিনি মুচকি হাসলেন। অতঃপর তিনি অর্ডার দিতেই আমার বুকে পড়ল সিল। যোগ দিলাম সিপাহী পদে। আমার আর্মি নম্বর: ৬৫৭৮১০৩।
প্রথমে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে পরে ঢাকার সিগন্যালে এবং সবশেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের ঝিলংয়ে। সেখানে নিই ছয় মাসের আর্মি ট্রেনিং।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় পঁয়ষট্টিতে। ট্রেনিং শেষে তখনই আমাদের কসম খাওয়ানো হয়। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিয়ালকোটে। ভারতীয় আর্মির বিরুদ্ধে ওখানেই আমরা যুদ্ধ করি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকলেও বাঙালিদের তারা উল্টো চোখে দেখত। ব্যারাকের ভেতর বৈষম্য ছিল অনেক। অফিসার পদে অধিকাংশ ছিল ওদের লোক।
সত্তরের নির্বাচনের পর আমি ছুটিতে বাড়ি আসি। দেশের অবস্থা তখন অন্যরকম। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছুটি শেষ। তবুও আব্বা আমাকে যেতে দিলেন না। বললেন, ‘দেশের কন্ডিশন খারাপ। তোমার আর যাওয়া লাগবে না।’ আমি আব্বার কথা ফেলতে পারলাম না। বারবার চিঠি আসে, আমাকে বলা হয় রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমি ঢাকাতেই থেকে যাই আব্বার কাছে।”
- ট্যাগ:
- মতামত
- যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা