বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মি!
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে একের পর এক জয়ের মুখ দেখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর দখলে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে আরাকান আর্মি রাখাইনের ১৭ শহরের মধ্যে ১৩টি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের মংডু, বুথিডাং এবং চিন প্রদেশের পালেতোয়া-এ তিনটি শহরেরই নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করছে, পালেতোয়ার সঙ্গে ভারতেরও সীমান্ত রয়েছে। আরাকান আর্মি এখন দক্ষিণ রাখাইনের গাওয়া, তাউনগুপ ও আন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করছে।
মংডু দখলের সময় আরাকান আর্মি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরিন তুনসহ মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের কিছু রোহিঙ্গাকেও গ্রেফতার করে। মংডুতে রোহিঙ্গাদের প্ররোচনা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র দেওয়া, ভয় দেখিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিতে বাধ্য করা এবং মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন সামরিক জান্তার হয়ে আরাকান আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। সামনের দিনগুলোয় প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনায় যাতে কোনো সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য এর যৌক্তিকতা সব পক্ষের কাছে তুলে ধরতে হবে। রাখাইনে সংঘর্ষের সময় আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের জোর করে তাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে এবং বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলে জানা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে। বহির্বিশ্বে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গি হিসাবে প্রচারণা চালাচ্ছে, এর বিপরীতে রোহিঙ্গা কিংবা তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সংস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচারণা নেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী জোর করে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছে, যা আন্তর্জাতিক মহলকে ভালোভাবে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। রাখাইনে এখন প্রায় পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে; চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশে বাধ্য করতে পারে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ উচ্ছেদের পর আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ক্যাম্পগুলোতে দায়িত্ব পালন করছে; ফলে সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির সদস্যদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়া এবং সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। অরক্ষিত সীমান্ত মাদক ও অস্ত্র পাচারকারীদের জন্য সুযোগ এনে দেবে; এতে নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়বে। বর্তমানে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনাসাপেক্ষে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাখাইনের চলমান সংঘাতে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ও রপ্তানি বন্ধ রয়েছে, সীমান্ত বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে। সংঘর্ষ চলমান থাকায় রাখাইন অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতিগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। জান্তা সরকার সড়ক ও জলপথ অবরুদ্ধ করায় সেখানে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধসহ আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। রাখাইনের প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আবারও বাণিজ্য শুরু হলে তা রাখাইনের জনগণের দুর্দশা কমাতে সাহায্য করবে।
রাখাইনে চীনের ভূ-কৌশলগত, বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ স্বার্থ রয়েছে। আরাকান আর্মি চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু করছে না, মিয়ানমার সরকারও চীনের স্বার্থরক্ষা করছে। রাখাইনে ভারতেরও বাণিজ্যিক এবং ভূ-কৌশলগত স্বার্থের পাশাপাশি চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য মোকাবিলায় তাদের উপস্থিতির বিষয় রয়েছে। ভারত আলাদাভাবে জাতীয় ঐক্য সরকার, আরাকান আর্মি, চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং চীন ব্রাদারহুডের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে, যদিও এর ফলাফল এখনো জানা যায়নি। চীন তার সীমান্ত বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভারত আবারও কালাদান মাল্টি মোডাল প্রকল্প চালু ও সিতওয়ে বন্দরের কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নিচ্ছে।