‘মব ভায়োলেন্স’ কি চলতেই থাকবে?

বিডি নিউজ ২৪ চিররঞ্জন সরকার প্রকাশিত: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৩২

গত কয়েকদিন ধরে দেশ খবরের শিরোনামে উঠে আসছে, ‘গণপিটুনি’ বা ‘মব ভায়োলেন্স’। দেশজুড়েই যেন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিষয়টি। আজ রাজশাহী তো কাল ঢাকায়। পরদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে। দেখা যাচ্ছে যেন মহামারীর মতোই গণপিটুনির ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সব থেকে যেটা আশ্চর্য এবং বেদনাদায়ক বিষয় হলো, এই ধরনের গণপিটুনির ঘটনা ঘটবার সময় যে ডিড় তৈরি হয়, ওই ভিড়ের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ ঘটনাগুলোর ভিডিও করছে এবং সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছে। এতে করে পুরো সমাজজুড়ে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। গণপিটুনির ঘটনা শুধু অমানবিকই নয়, একটা অদ্ভুত নারকীয় আনন্দের মধ্যে দিয়ে একটি মানুষকে পিটিয়ে মারা ঘৃণ্য অপরাধ। একজন অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি, সে অপরাধী কি অপরাধী নয়, সেটা আদালত কর্তৃক নির্ধারণ করার আগেই, তাকে নৃশংসভাবে মারধর করা, খুন করা, এই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করার চেয়ে নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর কী হতে পারে?


কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বেআইনি হিংসাত্মক ঘটনাকে বৈধতা দানের প্রথম শর্ত, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বিপরীতে এক বা একাধিক কাল্পনিক ‘প্রতিপক্ষ’ বা ‘শত্রুপক্ষ’ নির্মাণ, যারা সব দিক থেকেই ‘আমাদের’ তুলনায় খারাপ ও নিকৃষ্ট। নাৎসি জার্মানি থেকে পলপটের কম্বোডিয়া, বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি খড়্গহস্ত মিয়ানমার অথবা আমেরিকায় পুনর্বার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণ— সর্বত্র এই চেষ্টার উদাহরণ প্রকট। শত্রুপক্ষকে একবার নিকৃষ্ট প্রতিপন্ন করতে পারলে তার প্রতি যে কোনও নিষ্ঠুরতার বৈধতা অর্জন করা অনেক সহজ হয়। তার বিরুদ্ধে যেকোনো হিংস্রতা বা নির্যাতন স্বাভাবিক হয়। হিংস্রতার এই ক্রমাগত স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া ক্ষমতার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের বাস্তব পরিস্থিতি তৈরিতে কীভাবে সাহায্য করে, তার বহু উদাহরণ গবেষকরা পেশ করেছেন কার্যত দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকেই। বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা, কোটি মানুষের রুটি-রুজি কেড়ে নেওয়া, তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা— মানুষের প্রতি মানুষের অকল্পনীয় সব অত্যাচারের সাক্ষী হয়েছে পৃথিবী। ওই অত্যাচার করতে পেরেছে মানুষ, কারণ রাজনীতি আর সমাজ মিলে সেই অভাবনীয় হিংস্রতাকে ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছিল। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে উপজীব্য করে বিভিন্ন স্থানে মব-ভায়োলেন্সের নামে পিটিয়ে হত্যার যে মচ্ছব চলছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক।


মব ভায়োলেন্স জিনিসটা কি? সহজ কথায় বলা যায়, কিছু উত্তেজিত মানুষ বা ক্ষুব্ধ জনতা যখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এক বা একাধিক মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে সমবেতভাবে প্রহার করে তাকেই বলা হয় মব ভায়োলেন্স বা গণপিটুনি। অনেকে এটাকে মব জাস্টিস বলেন। যদিও এর সঙ্গে জাস্টিস-এর কোনো সম্পর্ক নেই। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মানুষ বা উত্তেজিত মানুষ কখনো বিচার বা রায় প্রদান করতে পারে না। এটা স্পষ্টতই ভায়োলেন্স বা সহিংসতা। সংঘবদ্ধ অপরাধ।



গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে কমপক্ষে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া যেকোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং এসবের দায় সরকারকে নিতে হবে। কিন্তু সরকার তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আর সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা তো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাকে পুরোপুরি অস্বীকারই করেছেন।


এটা স্পষ্ট যে, সরকারের গাফিলতির সুযোগে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ দীঘিনালার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার পর পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর জের ধরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-অভিবাসী সংঘর্ষে চারজন পাহাড়ি নাগরিক নিহত হন। এদের মধ্যে জুনান চাকমা, ধনঞ্জয় চাকমা ও রুবেল চাকমা গুলিতে নিহত হন। এবং ডিসি অফিসের খুব কাছে একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা ১৭ বছর বয়সী অনিক চাকমাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পাহাড়িদের অনেক ঘরবাড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে পুড়ে যায় অনেক বাড়ি-ঘর। অথচ মামুন হত্যায় তার স্ত্রী মুক্তা আক্তার যে মামলাটি করেছেন, সেখানে হত্যাকাণ্ডের জন্য ‘উপজাতি ও বাঙালি’দের দায়ী করেছেন। তিনি মামলায় যে তিনটি নাম উল্লেখ করেছেন, সেই তিন জনই বাঙালি।


গণপিটুনির বাইরে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতে। এসব মৃত্যু প্রমাণ করে দেশে সুষ্ঠু আইনের শাসন নেই। বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হোক আর গণপিটুনিতে হোক— সবই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। মব ভায়োলেন্স নৃশংস ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এর দায় তো সরকারের উপরই বর্তায়। কেননা জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের।


অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মব ভায়োলেন্সের ঘটনা বাড়ছেই। রাষ্ট্রের ন্যূনতম যে শৃঙ্খলা, তা এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। স্থিতিশীলতা আসেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কঠিনভাবে দক্ষতার সঙ্গে যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, তারা সেটা নেননি। সামরিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের বিচারিক (ম্যাজিস্ট্রেসি) ক্ষমতা দেওয়ার পরও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও