রোহিঙ্গা প্রশ্নে ত্রিমুখী কূটনৈতিক কৌশল সফল হবে কি?
বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করছে। ২০২১ সালে সামরিক জান্তার ক্ষমতা গ্রহণে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। বারবার মিয়ানমারের অসহযোগিতামূলক আচরণ বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে পশ্চিম মিয়ানমারে বিদ্রোহী ও সামরিক কর্মীদের মৃত্যু এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কারণে নতুন করে আবারও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে আট হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এ সংকটে নজর দেওয়া না হলে তা শুধু বাংলাদেশকেই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
আরাকান আর্মি এবং বার্মিজ সামরিক জান্তা রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা চালাচ্ছে এবং বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ইউকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার জন্য দ্রুত এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। ক্রমাগত সহিংসতার কারণে অনেক রোহিঙ্গা নৃশংসতা থেকে বাঁচতে নিরাপদ দূরত্বে যেতে বাধ্য হয়েছে।
প্রত্যাবর্তনের সময় সহিংসতার ভয় রোহিঙ্গাদের মনে চেপে বসেছে। এ ভয়ের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনসংখ্যা এক সময় মোট জনসংখ্যার প্রায় ত্রিশ শতাংশ ছিল। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে এবং তাদের বসবাসের অঞ্চলে প্রশাসনিক ভবন তৈরি করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শুরু থেকেই অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের বসবাসের ক্যাম্পগুলো অতিমাত্রায় জনবহুল এবং তারা বেশিরভাগই মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। হাজার হাজার শরণার্থীকে এমন একটি দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়েছে, যেটি ২০২০ সাল থেকেই ঘন ঘন বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবে, তা-ও সম্ভব নয়। ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকেই শিক্ষার মতো মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানের একটিই উপায়, আর তা হলো স্থায়ী প্রত্যাবর্তন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের পৈতৃক গ্রামে পদ্ধতিগত ও মানবিক প্রত্যাবর্তনের ওপর বাংলাদেশের অবস্থান অটল। যদিও স্থায়ী এসব শরণার্থীর একটি বিশাল জনসংখ্যা এ দেশের জনগণের কল্যাণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে বলে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। তবুও বাংলাদেশ এ সমস্যার সমাধানে শুরু থেকেই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং আসন্ন বিপর্যয়ের কার্যকর সমাধান খুঁজছে। অধ্যাপক ইউনূস সংকটের বর্তমান পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়নেরও আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে এবং ভবিষ্যৎ সমাধানের পরামর্শ দেওয়ার জন্য সর্ব-অংশীজনের সমন্বয়ে একটি সম্মেলন আহ্বান করবেন বলেও তিনি প্রস্তাব করেছেন।
বাংলাদেশ শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শূন্যতা পূরণের ব্যবস্থা নিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ার জন্য শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পশ্চিমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা উচিত। রোহিঙ্গা অভিবাসন বন্ধ এবং তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে এখন একটি সক্রিয় এবং সু-সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের যৌথভাবে পরিচালিত জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন ড. ইউনূস। এ লক্ষ্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
গত আগস্ট মাসের শুরুতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের চ্যালেঞ্জ রয়েছে ড. ইউনূস সরকারের সামনে। পাশাপাশি ইউনূস এবং অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন রোহিঙ্গা ইস্যুসহ অনেক কঠিন নীতিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে আমরা বিশ্বাস করি, শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। প্রফেসর ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ এবং ক্ষুদ্রঋণের অগ্রদূত, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পশ্চিমা সরকার এবং বিশ্ব দাতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংকট সমাধানের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, আরও মানবিক ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীকে উৎসাহিত করা। বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি এবং সুনামের কারণে ড. ইউনূসের সেই সক্ষমতা রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
পুনর্বাসন পদ্ধতি হলো দ্বিতীয় এবং জটিল ধাপ। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত হলো, কিছু রোহিঙ্গাকে অনিচ্ছাকৃত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে হাসিনা প্রশাসনের চেষ্টার নীতিকে সমর্থন না করা। এটি দেশের দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতির আলোকে স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তাই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পুনর্বাসনের বিষয়ে আলোচনা সহজ হবে না। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভারতে মিলিতভাবে ৩ লাখ ৪৫ হাজার শরণার্থী অবস্থান করছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসাবে তৃতীয় দেশে দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন।