রাজনীতির সংস্কার হলে উৎপাদন সম্পর্কের নয় কেন
‘সংস্কার’ এ সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে উচ্চারিত ও আলোচিত শব্দ। সবাই রাষ্ট্রের সংস্কার চায়। কেউ কেউ ‘রাষ্ট্রের মেরামত’ চায়। শব্দে সামান্য হেরফের। চাওয়া একই। বোঝা যাচ্ছে, এ রাষ্ট্রে অনেকেরই আর পোষাচ্ছে না। খানিক ঠিকঠাক করে ‘রাষ্ট্র’কে আবার ঝকঝকে তকতকে করতে ইচ্ছুক দেশের মানুষ। কেউ কেউ ঝামা-ইট দিয়ে ঘষে রাষ্ট্রের শরীর থেকে শেওলা-ময়লাও খানিক সরাতে চায়। এ রকম মানুষদের লক্ষ্য কিছুটা বেশি। কণ্ঠও কিছুটা উচ্চ।
কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি যে ভিত্তি বা অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের কথা খুব একটা শোনা যাচ্ছে না কোনো দিক থেকে। উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কারের কথা সম্ভবত আরও স্পর্শকাতর। শোনাই যায় না ওই আলাপ। সংস্কারের রূপকল্প তৈরি করতে সরকারিভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি। সেই তালিকায়ও ওই রকম কিছু নেই। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান যদি হয় ‘বৈষম্যে’র ‘বিরোধিতা’ থেকে, তাহলে নিশ্চয়ই বৈষম্যের উৎসের দিকে তাকাতেই হবে।
সংস্কার ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন
একটি দেশের রাজনীতির ধরন-ধারণ ঠিক করে সেখানকার অর্থনীতি ও উৎপাদন সম্পর্ক। এটাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গোড়ার কথা। উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিকানা যার, জমি ও কারখানাগুলো বেশির ভাগ যাদের হাতে, রাজনীতিতে তাদেরই প্রতাপ থাকবে—সেটাই স্বাভাবিক। ভারতে আদানি-আম্বানিরা, পাকিস্তানে শরিফ ও ভুট্টোরা কিংবা বাংলাদেশে সালমানরা এভাবেই তো অধিপতি শ্রেণি।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু হলেও তাঁরাই ‘জনপ্রতিনিধি’ হন বা জনপ্রতিনিধিদের কাছের মানুষ হিসেবে ‘রাজনৈতিক-অর্থনীতি’র অভিভাবক হয়ে ওঠেন। ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘সংস্কারে’র আন্দোলনে এই ধনীরা ঘাবড়ান না। সহজে এবং স্বল্প সময়ে তাঁরা এ রকম বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে পারবেন। দক্ষ ‘সমন্বয়কারী’ তাঁরা। হয়তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রত্যাশিত মেরামত শেষেও এ রকম সমন্বয়কারীদের জন্য বড় আকারে উদ্বেগের কিছু নেই।
কারণ, কেবল উপরিকাঠামোর সংস্কার অধিপতি শ্রেণির সামনে বড় আকারে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করে না—যদি না তাতে উৎপাদনব্যবস্থার সংস্কারও যুক্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এখন সেদিকেও যাবে কি না? রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের সুফল সবার কাছে নিতে সেদিকে না গিয়ে কোনো বিকল্প আছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে বাংলাদেশের ধনবৈষম্যের সাম্প্রতিক নির্মম চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এ বছরের শুরুতে অনেক দৈনিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ রকম উপাত্ত ছেপেছিল, শুধু গত ৫ বছরে এ দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৩০ হাজার! ২০১৯-এ যা ছিল ৮৪ হাজারের কম—এ বছরের শুরুতে সেটা ১ লাখ ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মাঝে করোনা গেছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত গেছে। বিশ্বে মন্দার শোরগোল শোনা গেছে। এ রকম কোনো ধরনের দুর্যোগ বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠীর সম্পদ সংগ্রহে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ব্যাংক আমানতের প্রায় অর্ধেক এই অল্প ‘হিসাব’গুলোর হাতে। নিশ্চিতভাবেই ‘সংস্কারে’র অ-অর্থনৈতিক অভিঘাতেও তারা দমে যাবে না।
উল্টো দিকে কী হচ্ছে? পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপকে (২০২২) উদ্ধৃত করে বাংলাদেশ প্রতিদিন এ বছরই রিপোর্ট করেছিল, সমাজের সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ মাত্র। আর একদম ওপরতলার ১০ শতাংশের আয় দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। একজন গরিবের তুলনায় একজন ধনীর আয় অন্তত ১১৯ গুণ বেশি। একজন গরিব ১ টাকা আয় করলে একজন ধনী আয় করেন ১১৯ টাকা।
এ রকম অবস্থায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের গণতন্ত্রায়ণ বা বাংলা একাডেমি ও বিটিভিতে কয়েকজন ভালো কর্মকর্তার নিয়োগ নিচুতলার ১০ ভাগের জীবনে কতটুকুই–বা আর পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তারা নিশ্চয়ই নির্বাচন করতে পারবে না। তাদের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার বহু আগেই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে। টিভির কোনো সংবাদ বা ফিচারে তাদের দেখানো হবে হয়তো কেবল জাতীয় পুষ্টি দিবসের তথ্যচিত্রে। কিংবা আশুলিয়ার শ্রমিক বিক্ষোভে তাদের সন্তান অজ্ঞাত গুলিতে নিহত হলে। অথচ এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গণ-অভ্যুত্থান শেষে বারবার উচ্চারিত সংস্কারের কথা তো এ রকম মানুষজনকে দেখিয়েই। সুতরাং সংস্কারের প্রশ্নের সঙ্গে দেশের সম্পদ পুনর্বণ্টনের রয়েছে গভীর যোগ। দুটোকে আলাদা করে বিবেচনা করা মানে স্পষ্ট বেইমানি। কিন্তু সম্পদ পুনর্বণ্টনের আওয়াজ কোথায়?