প্রবাসীদের মেধা ও দক্ষতাকে সরকার কীভাবে ব্যবহার করবে
করোনাকালে নানা অব্যবস্থাপনা ও অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গিয়েছিল বিগত সরকারকে। প্রায় ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে আমরা যারা প্রবাসে থাকি, তারা অনেকই উৎকণ্ঠায় ছিলাম। ওই সময় প্রবাসী গবেষক, একাডেমিশিয়ানরা মিলে একটি স্বেচ্ছাসেবী টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাল্টি-ডিসিপ্লিনিয়ারির এই কমিটিতে কানাডা, জাপান, কাতার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার এক ঝাঁক তরুণ গবেষক, বিজ্ঞানী ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছিল, যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কোভিড নিয়ে গবেষণা করছিল। বেশ কয়েকবার বৈঠক করে কোভিড মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের করণীয় ঠিক করা হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা এই বিষয়গুলো সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জানাব।
তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক ব্যক্তিগত সচিবকে আমাদের পরিকল্পনার কথা যখন জানাতে গেলাম, তখন অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো। তিনি তখন আমাকে বললেন, ‘আমারে কনভেন্স করতে চাচ্ছে যে তোমরা সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী। আমরা যখন দু টাকার সাংবাদিকতা করি, তখন তুমি পিএইচডি করতে গেছ। এত দিন পর এসে তোমার মনে হলো সরকারকে জ্ঞান দিতে হবে। তোমার পরামর্শ সরকারের কর্মকর্তারা নেবে কেন?’
এই দুই-বাক্য এমনভাবে হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল, আমাদের দল আর বিষয়টি নিয়ে আর সামনে যেতে রাজি হলো না। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার প্রবাসীদের সক্ষমতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখার পাশাপাশি এই সব স্ব-উদ্যোগে দেশসেবা করতে আসা প্রবাসীদের রাজনৈতিক মেরুকরণে ফেলায় এভাবে অনেকের আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। নিজেদের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দেশের দুর্দিনে আমরা পাশে দাঁড়াতে পারিনি, এর চেয়ে বেদনার আর কী আছে।
এবার ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান আমরা দেখলাম, তাতে সত্যিই আমরা একটি অন্যরকম প্রতিশ্রুতিশীল বাংলাদেশ গড়ার দ্বার প্রান্তে। এই আন্দোলনের সময় দেশের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রবাসীরা যেভাবে সরব ভূমিকা পালন করেছে তা সত্যিই প্রশংসাজনক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ‘রিভার্সব্রেনড্রেনবিডি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত প্রবাসী গবেষক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেশে ফিরে দেশটাকে নিজেদের মতো গড়ার অঙ্গীকার করেছিল। যাঁদের একাডেমিক প্রোফাইল দেখলে যেকোনো দেশ তাঁদের লুফে নিবে।
গত কয়েক দশক যেভাবে একমুখী মেধাপাচার হয়েছে, তাতে দেশে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার খেসারত দেশ দিয়েছে। তৎকালীন সরকার প্রধান বিভিন্ন সময় সরাসরি টেলিভিশনে বলেছে, আমাদের তো লোকের অভাব নেই, যাঁরা দেশ ত্যাগ করেছে, তাতে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি বরং রেমিট্যান্স আসছে, দেশ উপকৃত হয়েছে। সরকার প্রধানের এইরকম বক্তব্যের খেসারত ক্ষমতার পতনের মধ্য দিয়ে হয়েছে। যাই হোক, এখনই উপযুক্ত সময়, দেশের বাইরে থাকা এক ঝাঁক মেধাবীদের দেশে ফেরানোর। আন্তর্জাতিক মানের বেতনের দরকার নেই, শুধু নিরাপত্তা ও সচ্ছলভাবে চলাফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে হাজারো প্রবাসী দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যাই হোক এই লেখার উদ্দেশ্যে ছিল, আমরা কীভাবে আমাদের প্রবাসীদের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
অভিজ্ঞদের তালিকা প্রণয়ন
দেশের বাইরে এইমূহুর্তে ঠিক কতজন প্রবাসী আছেন, তার হিসেব সরকারের কাছে কাগজে কলমে থাকলেও ঠিক কে কোন পেশায় আছেন কিংবা কে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাঁর কোন ডেটাবেইস সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে আছে বলে জানা নেই। বিষয়টা এমন হয়ে গিয়েছে যে সরকারের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্কটা কেবলই পাসপোর্ট নবায়ন আর রেমিট্যান্স আদায়। অথচ দেশে একটি প্রবাসীদের জন্য একটি মন্ত্রণালয়ই আছে। যা হোক সেই প্রসঙ্গে না যাই।
প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা ও মেধাকে কাজে লাগাতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন কে কোন বিষয়ে অভিজ্ঞ তার তথ্য সমাহার। সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশের সেবা করার মানসিকতায় থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের আহ্বান জানাবেন। প্রবাসীদের সরকার ঠিক কোন কোন কাজগুলোতে সহায়তা নেবেন, তার তালিকা প্রণয়ন করে আগ্রহী বিশেষজ্ঞদের তথ্য সংগ্রহ করবেন।
এই ক্ষেত্রে সরকার তাঁর দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে যেমন এই তথ্যগুলো সংগ্রহ রাখতে পারেন, তেমনি রিভার্সব্রেনড্রেন হ্যাশট্যাগে দেওয়া শত শত প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের ডেটা একটি ওয়েবসাইটে সন্নিবেশিত করতে পারেন। ক্যাটাগরি করে তালিকা প্রণয়ন করে সেখান থেকে সরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে দেশ গঠনে সহায়তা চাইতে পারেন। মনে রাখবেন, দেশের বাহির যাঁরা আছেন, তাঁরা হয়তো দেশে ফিরবেন না, তবে তাঁদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে কোনো সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কর্মদক্ষতা
- মেধা
- প্রবাসী বাংলাদেশি