
আমরা যেভাবে ইতিহাসের শরিক হলাম
দেশের বাইরে থেকে ঢাকায় ফিরেছি ৩০ জুন। তখন থেকেই টের পাচ্ছিলাম, শহরে অস্থিরতা জমছে। জুলাইয়ের শুরুর দিকেই সেই অস্থিরতা আন্দোলনের ঢেউ তুলতে শুরু করল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখছিলাম প্রতিদিন। এর আগেও অনেক আন্দোলন দেখেছি; কিন্তু এবার যেন কিছুটা আলাদা ঠেকছিল। প্রথম যে স্লোগানটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি ছিল, ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!’
আমি ঘৃণা করি সেই সব মানুষকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তাই ‘রাজাকার’ শব্দটা শুনলেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। আমার কাছে এটা অপমানের প্রতীক, একটি অভিশপ্ত পরিচয়; কিন্তু যখন দেখলাম, এ গালিটাকেই মানুষ প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, তখন বুঝলাম, এটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনাপ্রসূত আন্দোলন না, এটি দীর্ঘদিনের জমা ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
অপমান, কষ্ট, রাগ—সব যেন ওই স্লোগানে ফেটে পড়ছিল। মূলত শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলার পর তীব্র ক্ষোভে শিক্ষার্থীরা স্যাটায়ার অর্থে এই স্লোগান দিয়েছিলেন।
আমার নিজের জীবনেও এমনটা হয়েছে। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেন। এতে আমি ভেঙে পড়ি না। কারণ, আমি এই গালিগুলোকেও নিজের ভেতরে গ্রহণ করে ফেলেছি। আমি জানি, এসব শব্দ দিয়ে আমাকে আর ভাঙা যাবে না। আমার আত্মসম্মান এখন তাদের শব্দে নির্ভর করে না।
যাহোক, ছাত্রদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি রকমের নির্যাতনের কারণে আন্দোলন বড় হতে লাগল। আমি নিয়মিত টক শোগুলো দেখছিলাম। দেখছিলাম, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সত্যি ঘটনা উঠে আসছে আর সরকার ও সরকার-সমর্থকেরা তা অস্বীকার করছেন।
আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। সরকার বলল, সে মাদকাসক্ত ছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারফিউ জারি হলো। নিউজ চ্যানেলগুলো প্রতিদিন মিথ্যাচারে ভরিয়ে তুলল, যেন কিছুই ঘটেনি। একসময় হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালানো শুরু হলো। নিরীহ মানুষ, যাঁরা বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদেরও রেহাই দেওয়া হলো না।
কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও একটি মৃত্যু আমাকে ভেতর থেকে একেবারে নাড়া দিয়েছিল। সেটি রিয়া গোপের মৃত্যু। ওই দিন আমার ছোট মেয়েটাও ছাদে গিয়েছিল আমার বাবার সঙ্গে। আমি তখন বারবার ভাবছিলাম, রিয়ার জায়গায় তো আমার মেয়েও হতে পারত! একই সময়, একই দেশ, একই শহর—শুধু ভাগ্যটা আলাদা।
সরকার থামেনি। তারা প্রতিদিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছিল। প্রতিদিন চোখে চোখ রেখে আমাদের বিশ্বাস করাতে চাইছিল, ‘তোমরা যা দেখছ, তা ঘটেনি। আর যা ঘটেনি, সেটিই বাস্তব।’ সরকার যখন জনগণকে বোকা বানাতে চায়, তখন সত্যের চেয়ে বড় প্রতিরোধ আর কিছু হতে পারে না।
২৯ জুলাই: সাহসের শুরু
২৯ জুলাই চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান ভাই আমাদের মিডিয়া গ্রুপে একটি বার্তা দেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন এবং নির্বিচার গ্রেপ্তারের নিন্দা জানাচ্ছি এবং আহ্বান জানাচ্ছি, চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্রকর্মীদের একটি নির্দিষ্ট দিনে মানববন্ধনে অংশ নিতে। যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
আমি তখনো কিছু লিখিনি। ভয় হচ্ছিল, যদি আবার গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়? তবু সাহস করে আকরাম ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে টেক্সট করলাম। তিনি জবাব দিলেন, ‘আপনি যেহেতু আমাকে টেক্সট করেছেন, তাহলে এবার সাহস করে গ্রুপেই লিখুন—আপনি যাবেন।’ আমি ভয় কাটিয়ে গ্রুপেই লিখলাম, ‘আমি যাচ্ছি।’
তারপর আমরা অনেকে মিটিং করলাম, সেখানে ছিলেন অনেকে—শিল্পী, আলোকচিত্রী ও টেকনিশিয়ান। আয়োজক গ্রুপের নাম ঠিক হলো, ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জুলাই বিপ্লব