
মার্কিন শুল্ক ও বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন সংকট
বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থা নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা মুক্তবাণিজ্যের ধারণা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সংরক্ষণবাদের ঢেউ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। এই অনিশ্চয়তার কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাণিজ্যনীতি, যা শুধু ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে না, বরং এর ঢেউ আছড়ে পড়ছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর।
২০২৫ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (Reciprocal Tariff)’ নামে দেশভিত্তিক একটি পাল্টা শুল্কনীতি ঘোষণা করেন। এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল দেশটির দেশীয় শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ‘অন্যায্য বিদেশি বাণিজ্য অনুশীলন’ প্রতিরোধ করা।
ট্রাম্প প্রশাসনের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল যে, বহু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অসম বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, যেখানে মার্কিন পণ্য উচ্চ শুল্কের সম্মুখীন হয়, অথচ তাদের পণ্য অবাধে মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার পায়। এই ‘অন্যায্য’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতিকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতির সবচেয়ে বড় এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মার্কিন-চীন বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর, যা ইতিমধ্যেই কয়েক বছর ধরে চলমান একটি ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শুরু থেকেই চীনকে লক্ষ্য করে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়, যার জবাবে চীনও মার্কিন পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে।
এই বাণিজ্য যুদ্ধ শুধু দুটি বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল যে, চীন ‘অন্যায্য’ বাণিজ্য অনুশীলন, যেমন মেধাস্বত্ব চুরি, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাড়াচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করে, যা কিছু ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশেরও বেশি ছিল।
উদাহরণস্বরূপ, সৌর প্যানেল, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়। চীনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন কৃষি পণ্য, বিশেষ করে সয়াবিন এবং অন্যান্য শিল্প পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এই বাণিজ্য যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে ধীর করা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে চীনকে বিচ্ছিন্ন করা।
যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি ছিল, এর ফলে মার্কিন শিল্প পুনরুজ্জীবিত হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে, তবে বাস্তবে এর মিশ্র প্রভাব দেখা গেছে। কিছু মার্কিন শিল্প সাময়িক সুবিধা পেলেও, অনেক মার্কিন কোম্পানি উচ্চ শুল্কের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং চীনা বাজারের প্রবেশাধিকার হারানোর মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
নতুন এই নীতির আওতায়, সব ধরনের আমদানির ওপর ১০ শতাংশ হারে সর্বজনীন শুল্ক আরোপ করা হয়। এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ, যা সব আমদানিকারক দেশের জন্য প্রযোজ্য। তবে, এই নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত অংশটি হলো, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, তাদের জন্য আলাদা করে বাড়তি শুল্ক ধার্য করা।
অর্থাৎ, যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের পণ্যের বিশাল চাহিদা তৈরি করে রেখেছে এবং বিপরীতে মার্কিন পণ্য তেমন আমদানি করে না, তাদের ওপর আরও কঠোর শুল্কের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন তার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চাইছে, অন্যদিকে তার দেশীয় শিল্পকে বিদেশি প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি
- শুল্ক আরোপ