দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা দরকার
বিপদ কখনো বলে-কয়ে নোটিস দিয়ে আসে না—কথাটি আবার প্রমাণ হলো বাংলাদেশে। তা না হলে এক কঠিন সময়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাসেই এমন ওলট-পালটের ঘটনা ঘটত না। হঠাৎ বিপদ। ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে ‘কোটা’ প্রথা বাতিল হয়। এই কয়েকদিন আগে হাইকোর্ট এ প্রথা পুনর্বহালের আদেশ দেন। বিষয়টি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন অবস্থায়ই ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমে পড়েন। এর নাম দেয় অস্বাভাবিকভাবে প্রথমে ‘বাংলা ব্লকেড’ এবং পরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। তার পরের কথা সবারই জানা। বিটিভি অফিসে আগুন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং মেট্রোরেলে অগ্নিসংযোগ, জেলখানা ভাঙা, বাসে অগ্নিসংযোগ। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, বহুলোকের প্রাণহানি, মনে হয় স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক গুলিতে প্রাণহানি। এসবই অপ্রত্যাশিত এমন সময়ে যখন আমরা বিশ্বে ৩৩তম অর্থনীতি। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে। ২০৪১ সালে এর উত্তরণ ঘটবে স্মার্ট বাংলাদেশে। তখন আমাদের লক্ষ্যমাত্রা: দারিদ্র্য সংখ্যা হবে মাত্র ৩ শতাংশ। চরম দারিদ্র্য হবে শূন্য। ‘রাজস্ব ও জিডিপি’ অনুপাত হবে অনেক উঁচুতে ২০ শতাংশ। সমাজ ও দেশের অর্থনীতি হবে ‘ক্যাশলেস’। এমন সময়ে আমরা নতুন বিপদের মুখোমুখি হলাম, যখন ১৫ বছর ধরে অবিরাম গড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। শিক্ষার হার, সাক্ষরতার হার, নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। অবকাঠামোর উন্নয়ন ঈর্ষণীয়। এমন সময়ই আচমকা বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ, কলিজা নাড়িয়ে দেয়ার মতো ঘটনা।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাতব্যাপী দীর্ঘদিন সান্ধ্য আইনের পর এখন আবার সান্ধ্য আইন। সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত। মিল-ফ্যাক্টরি কয়েক দিন বন্ধ থেকে ধীরে ধীরে আবার চালু হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন ব্যবসা, পর্যটন ব্যবসাসহ যাবতীয় ব্যবসা। একটি কাগজে ক্ষতির যে হিসাব দেয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায় পোশাক খাতে ক্ষতি হয়েছে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিমানে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে ক্ষতি ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। স্টিল ও সিরামিক খাতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করে, সিমেন্ট খাতে ৬০০ ও ই-কমার্স খাতে ৪২০ কোটি টাকা এবং সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ৬ হাজার কোটি টাকা। আমার ধারণা এসব ক্ষতির হিসাব আংশিক মাত্র। টাকা-পয়সার ভিত্তিতে হিসাবের বাইরের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিকভাবে ভাবমূর্তি বিঘ্নিত। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে আমরা এখন প্রথম গন্তব্য স্থান নই। সরকারের ভাবমূর্তি বিঘ্নিত। এমন যে এক অবস্থা তার জন্য কি আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম? নিশ্চিতভাবেই না। অথচ বিপদ-মহাবিপদটা ঘটল। দেশ ও জাতির জীবনে এমন ঘটনা কি বিরল?
আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে হঠাৎ নেমে আসে বিশ্বমন্দা। শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে। অ্যালান গ্রিনস্প্যান নামীয় এক ‘ফেড রিজার্ভ’ চেয়ারম্যানের ‘ইজিমানির’ বদৌলতে মার্কিন অর্থনীতি বাতাসে উড়ছে। টাকা আর টাকা সর্বত্রই টাকা। লোক বাড়ি কিনছে, ফ্ল্যাট কিনছে। আবাসন শিল্প রমরমা। হঠাৎ চাকরির বাজারে মন্দা। লোকেরা কিস্তির টাকা দিতে না পারায় খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। একের পর এক ব্যাংক, বীমা, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, ডিরাইভেটিভ কোম্পানি ভূপতিত হতে থাকে। ‘সাব-প্রাইম’ নামীয় ওই ধস সারা বিশ্বকে গ্রাস করে, যার ধকল আজও চলছে। তখন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে শাসকদের মার্কিনীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। আমেরিকা কি এর জন্য প্রস্তুত ছিল? মনে হয় না। আজ থেকে দু-তিন দশক আগের কথা। শ্রীলংকা আমাদের এ অঞ্চলে সবচেয়ে ঈর্ষণীয় দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক খাতের উন্নতিতে তারা শীর্ষে। চারদিকে প্রশংসা। হঠাৎ শ্রীলংকায় গোলযোগ। দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ। তামিল হিন্দুরা শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘এলটিটিই’ গড়ে তোলে। প্রবল এ গৃহযুদ্ধে শ্রীলংকার উন্নয়ন তছনছ হয়। ছয় লাখ তামিল হিন্দু মুসলমানের রক্তে এবং বিদেশী হস্তক্ষেপে শ্রীলংকা কিছুটা শান্ত হয়। এটা শেষ নয়। এক-দেড় বছর আগে শ্রীলংকা যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই আবার বিপদ আসে বিনা নোটিসে। দেশটি দেউলিয়া দেশে পরিণত হয়। মূল্যস্ফীতি আকাশে ওঠে। আমরাও ডলার দিয়ে সাহায্য করি। প্রতিবেশী ভারতেও এ রকম হঠাৎ বিপদ আসে ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে। বৈদেশিক রিজার্ভ শূন্যের দিকে ধাবিত। ভারতবাসী তাদের নিজেদের সঞ্চিত স্বর্ণ ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’কে ধার দেয় সংকট থেকে উত্তরণের জন্য। এসব তো বাইরের উদাহরণ। আমাদের অবস্থা কী? ২০১৯ সালে কি বড় বিপদ কভিড-১৯ আমাদের বলে-কয়ে চীন থেকে এসেছিল? নিশ্চয়ই নয়। অথচ আচমকা এ বিপদ আমাদের তছনছ করে দেয়। তাজা একটা যুবক ‘হার্ট অ্যাটাকে’ রাস্তায় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়। দারুণ ঘটনা। আমাদের পায় কে? না, ২০১৯-২০-এ এসে সে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে। ‘কভিড-১৯’-এর ফল। কী মারাত্মক অবস্থা! সমাজ, অর্থনীতি, প্রশাসন, চিকিৎসা ব্যবস্থা সব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। হাজার হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। কেউ আমরা ভাবিনি এমন ‘বাড়ি’ আমরা খাব। যেমন পূর্ব এশিয়ার টাইগার অর্থনীতির দেশগুলোও দু-তিন দশক আগে ভাবেনি তাদের অধঃপতন হতে পারে। এটাই শেষ নয়। কভিড-১৯ থেকে মুক্তি পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি আমরা।
২০২০-২১ ও ২০২১-২২-এ এসে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা নিয়ে অর্থনীতিকে বাঁচাতে হয়। আবার ৭ শতাংশের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়। এবার বলুন, আমরা কি তখনো ভেবেছিলাম যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে শেষ করতে শুরু করবে? নিশ্চিতভাবেই নয়। অথচ তাই ঘটল। যখন আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলাম, তখনই এ যুদ্ধের ক্ষতির সম্মুখীন হলাম। বিপদ কাকে বলে। আবার বিনা নোটিসে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব বিপাকে পড়েছে। আমরা একটু বেশি। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ—চাল, তেল, চিনি ও যন্ত্রপাতি সবই আমাদের আমদানি করতে হয়। আবার রফতানি সীমিত, তাও কয়েকটি দেশে, মাত্র একটি পণ্য। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘটে রিজার্ভের পতন। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সরকারের ঋণ বাড়ছে। ঋণ ও সুদের টাকা দিতে অসুবিধা হচ্ছে। আমদানি সংকুচিত করতে হচ্ছে। রেমিট্যান্স সেভাবে বাড়ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নানা শর্ত নিয়ে হাজির। তদারকি আর নজরদারি তাদের। জনজীবন পর্যুদস্ত। মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দুই বছর ধরে। এরই মধ্যে এত বিপদ-আপদের মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছয়ের নিচে রাখা যাচ্ছে। দরিদ্রদের খাদ্য সাহায্য দিতে হচ্ছে। দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। মধ্যবিত্ত শহর ছাড়ছে। বিপদ আর বিপদ। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে ২০২৪-এর শুরুতে নির্বাচন। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি সরকার। চারদিকে অসন্তোষ, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ। এরই মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অনেকটা ‘সংযত’ বাজেট ঘোষিত হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে গড় ৮ শতাংশের স্থলে ৬ শতাংশ। বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে। অবশ্য সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি। ডলার পরিস্থিতি এখনো অস্বাভাবিক। বিদেশী সাহায্য, ঋণ, অনুদান আশানুরূপ নয়। তবু সই, শুরু তো হলো। চেষ্টা করা যাক স্থিতিশীলতার জন্য। যতটুকু হয়েছে ততটুকুই ধরে রাখাটাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ। ধীর সন্তর্পণে চলার পথ ধরেছে সরকার। খরচ কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। বাজার ঠিক রাখার চেষ্ট হচ্ছে। কিন্তু না—আবার তৃতীয়বারের মতো বিপদ।
এবার ছাত্র আন্দোলন। ইস্যু কী? কোটা, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। পরীক্ষার ফলকেই বলা হচ্ছে মেধা। যেটা ‘প্রসেস অব ইলিমিনেশন’ সেটাই চিহ্নিত মেধা হিসেবে। তাও কত চাকরির জন্য? দেশে বেকারের সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকার অনেক—গ্র্যাজুয়েট, মাস্টার্স ইত্যাদি। এর বিপরীতে সরকারি চাকরি বছরে কয়টি? হতে পারে মাত্র দুই-চার-ছয় হাজার। এ কয়টা চাকরিতে, সোনার হরিণের জন্য লাখ লাখ যুবক-যুবতী রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে—মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ চাই। অথচ ২০০ এমসিকিউ, ৯০০ লিখিত পরীক্ষা এবং ২০০ মৌখিক পরীক্ষা—এই ১ হাজার ৩০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই সবাই চাকরির যোগ্য হয়। এখানেও গণ্ডগোল। কিছুই বোঝা গেল না, কেন কয়েকটা চাকরির জন্য ছেলেমেয়েরা এত পাগল। সরকারি চাকরি এখন লোভনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা নিজ পেশা ছেড়ে উপজেলা কর্মকর্তা, এসি, ডিসি, কাস্টমস, আয়কর, পুলিশ কর্মকর্তা হতে আগ্রহী। এজন্য হাজার হাজার, লাখ লাখ ছেলেমেয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে বিশ্ববিদ্যালয়। বিবিএ/এমবিএ সর্বত্র। অথচ অনেকেই ইংরেজি বা বাংলায় একটি চিঠি লিখতে পারে না—এসব খবর ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন। বেসরকারি চাকরিতে আকর্ষণ নেই। যখন-তখন চাকরি যায়। আর সরকারি চাকরি—অফিসে গেলেও বেতন, না গেলেও বেতন। মোটা বেতন, প্রচুর সুযোগ-সুবিধা। উপসচিব গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, পদোন্নতি শনৈঃশনৈঃ। পাঁচ কাঠা জমি প্রায় বিনামূল্যে। অতএব চাই সরকারি চাকরি। যেকোনো মূল্যে—তদবির করে, প্রশ্ন ফাঁস করে, ঘুস দিয়ে—যেকোনো মূল্যে।