কী শেখা হলো আমাদের!
কী শেখা হলো আমাদের! ৫৩ বছরের স্বাধীনতা। আর আওয়ামী লীগ একাধারে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায়। কোনোটাই কম নয়। এখন তো ফাইন টিউনিং ব্যবহার করার সময় চলে আসা উচিত ছিল। রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চলবে না, সিগনালের লাল আলো জ্বললে জনশূন্য পথেও গাড়ি থেমে যাবে, মানুষ বাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ময়লা ফেলবে না, অন্যের এতটুকু অসুবিধা না করে বরং স্বেচ্ছায় যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে বাড়ি তৈরি করবে, কোন ওষুধটি খাওয়ানো হয়নি রোগীকে, তা কেন্দ্রীয়ভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, ছোট্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও তাদের কর্মচারীদের পরিচয়পত্র দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সরকার কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে যে কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করল, তা রাজনৈতিক দীনতা ও অদক্ষতারই প্রকাশ। শুধু তা-ই নয়, সরকারি দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়েও দলের মধ্যেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কেউ কোনো দাবি তো সরকারের কাছেই করবে! আর দাবি উত্থাপিত হওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সে বিষয়ে সম্মানের সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে—গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটাই কাঙ্ক্ষিত। সব দাবি মেনে নিতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। তবে যুক্তি, দরদ ও মায়া-মমতার সঙ্গে তাকে পর্যালোচনা এবং দাবি উত্থাপনকারীদের সঙ্গে মতবিনিময় করাই কর্তব্য বলে বোধ হয়।
আন্দোলনকে শুরুতে গুরুত্ব না দেওয়া রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। যদি ধরে নিই সাধারণ ছাত্ররা রাজাকারের অনুসারীদের ফাঁদে পা দিয়েছে, তবুও আমার ধারণা, সেটা পরে ঘটেছে। প্রথমদিকে ঘটেনি। তাহলে প্রথমেই কেন এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া হলো না। কেন তাকে বাড়তে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো! আর যদি আমার ধারণা ভুলও হয়, অর্থাৎ শুরু থেকেই ধ্বংসাত্মক লোকজন সঙ্গে ছিল, তবু একই প্রশ্ন—শুরুতেই কেন এই দাবি নিষ্পত্তি করা হলো না? সম্ভবত সরকারে চৌকস, নিষ্ঠাবান, অভিজ্ঞ রাজনীতিকের অভাব এই আন্দোলনে প্রকাশ পেয়েছে।
এতে আওয়ামী লীগের দল হিসেবে সামর্থ্যের ঘাটতিও স্পষ্ট হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এবং পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের আশ্রয়ে থাকার ফলে তাদের নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে একটা ফোলা-ফাঁপা ধারণা তৈরি হয়েছিল। নিজেদের মধ্যে স্বার্থ নিয়ে অন্তঃকলহ এবং বিভাজনও এর অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে যদি ধরে নিই আন্দোলনকারী ছাত্রদের সবাই যথেষ্ট সচেতন নাগরিক এবং তারা দাবি আদায়ে একনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে পারে, তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলেই কথাটি আসে), দেশে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে যখন দরিদ্রের নাভিশ্বাস, তখন কেন তাদের এই অঙ্গীকার দেখতে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া সামাজিক বিশৃঙ্খলা, ঘাটে ঘাটে সেবার ঘাটতি, জ্ঞান অর্জনের প্রতি অনীহা, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার—এসব ক্ষেত্রেই বা তারা একেবারে চুপ কেন! এ ব্যাপারেও কি সরকারের কোনো ভূমিকা নেই!
ছাত্ররাজনীতিতে পড়াশোনা বলে আর কিছু নেই। যারা সাধারণ ছাত্র, তারাও পড়াশোনা করছে না। ক্লাসের বইও না, অন্য বইও না। শুনতে পাই শুধু নোট পড়ে পরীক্ষা দেওয়া এখনকার রীতি। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তাঁর বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পরীক্ষার্থী আছে, কোনে শিক্ষার্থী নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তো প্রধানত জ্ঞান অর্জনের জন্য। অবাক লাগে কেমন একটা অদ্ভুত প্রজন্ম তৈরি করে ফেলেছি আমরা! বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া নাগরিকের তো সব অর্থেই আদর্শ ও নির্ভরযোগ্য হওয়ার কথা। চিন্তায়, মননে, জ্ঞানে প্রথম শ্রেণির নাগরিক হওয়ার কথা। শিক্ষকদের আদর্শ নিয়েও বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। সে আলোচনায় এখন না গিয়েও বলা যায়—উচ্চশিক্ষায় বড় রকমের একটা রিফর্ম দরকার।