রফতানির ক্ষেত্রে বিরাট ‘তথ্য জালিয়াতির’ দায় কার

বণিক বার্তা ড. আর এম দেবনাথ প্রকাশিত: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬

কাকে কে ডোবাচ্ছে—বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে (ইপিবি)’ ডোবাচ্ছে, না ‘ইপিবি’ ডোবাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে? নাকি দুই প্রতিষ্ঠান মিলেই ডোবাচ্ছে সরকারকে। হতে পারে আরো প্রতিষ্ঠান জড়িত। ‘ডোবাচ্ছে’ বলছি এ কারণে যে রফতানির ক্ষেত্রে বিরাট ‘তথ্য জালিয়াতির’ ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য জালিয়াতি এক কোটি, শতকোটি বা হাজার কোটি টাকার নয়। জালিয়াতিটি প্রায় ১৪ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান শতকোটি) ডলারের। ভাবা যায় কত টাকা, তাও এ সংকটের দিনে, যখন আমাদের বাজারে ডলারের হাহাকার। ঘটনাটি কী? একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রফতানি হয়েছে কম, দেখানো হচ্ছে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রকৃত অর্থেই রফতানি হয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ ইপিবি পরিসংখ্যান দিচ্ছে যে এ সময়ে আমাদের রফতানির পরিমাণ হচ্ছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের তথ্য ‘বিভ্রাট’, ‘জালিয়াতি’। এর পরিমাণ কত হয়? ১৪ বিলিয়ন মানে ১ হাজার ৪০০ কোটি। আর ১ ডলার মানে বর্তমান বাজারে ১২০ টাকা। এখন বলুন কত টাকা হয়? প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এ পরিমাণ টাকার রফতানি আয় উধাও। বলা যায় ‘ডাকাতি’, বড় ধরনের ডাকাতি।


এত বড় ঘটনা যে আমাদের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী পর্যন্ত বিব্রত। তিনি বলছেন, এটা কোনো ছোটখাটো ভুল না। কোনো আমলা কাউকে খুশি করার জন্য এমনটা করেছে কিনা সেটা খুঁজে বের করতে হবে। শুধু সাবেক মন্ত্রী নন, অর্থনীতিবিদ এমনকি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পর্যন্ত রীতিমতো অবাক! এত বড় ঘটনা কী করে, কারা ঘটাল? যারাই ঘটাক, যেভাবেই ঘটাক, যে কারণেই ঘটাক, যাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই ঘটাক না কেন—ক্ষতি যা করার তা তারা করে ফেলেছে। রফতানির তথ্য অতিরঞ্জিত মানে এর আঁচড় পড়বে সবকিছুতে। জিডিপির পরিমাণে, প্রবৃদ্ধির হারে, মাথাপিছু আয়ে। আর রফতানির তথ্যের সঙ্গে যার তুলনা করা হয়—এসবের ওপরও এ জালিয়াতির বোঝা পড়বে। লজ্জায় মাথা হেঁট হওয়ার কথা। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছর নয়, এর পূর্ববর্তী বছরগুলোয়ও এ তথ্য জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। কাগজে এর পরিমাণ প্রতিবেদন আকারে ছাপা হয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনার কথা আমরা এখন পাচ্ছি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সৌজন্যে। তারা বলছে, তোমাদের হিসাব/হিসাবায়ন পদ্ধতি ভুল। এক রফতানিকে তোমরা দু-তিনবার যোগ করে এ অবস্থা করেছ। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়। ইচ্ছাকৃত, না অজ্ঞতাবশত, না ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে এটা করা হয়েছে তা আমাদের বোঝা দরকার। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। এ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ পাচার সংঘটিত হয়েছে কিনা তাও বিবেচনা করে দেখা দরকার।


দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এখন আমরা তথ্য/পরিসংখ্যান জগতে কী ঘটছে তা বুঝতে পারছি না। তবে কি সর্বত্রই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে? এ সন্দেহ জাগছে আরো একটি কারণে। এই তো সেদিন আমরা দেখলাম আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ঘটনা। আমরা সমানে বলে যাচ্ছিলাম, আমাদের ডলার রিজার্ভ বাড়ছে তো বাড়ছেই। ২০২০ সালের নভেম্বরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, দেখবেন পরবর্তী ১৪ মাসের মধ্যে আমাদের ডলার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। তিনি শুধু এ কথাই বলেননি। বলেছিলেন, ‘আমাদের রিজার্ভ যদি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করি, সেক্ষেত্রে দেশের টাকা দেশেই থাকল, বাইরের ঋণ ব্যবহার হলো না, ঋণের দায়ও বাড়ল না।’ কী মারাত্মক সব তথ্য এবং মন্তব্য ও বিশ্লেষণ যা এতদিন পর আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। তিনি ওই কথাগুলো বলেছিলেন ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর। আর আজ ২০২৪ সালের জুলাই। রিজার্ভ কত? সর্বনাশ আরো করা হলো। রিজার্ভকে স্ফীত দেখিয়ে এর থেকে আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ডলারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নেয়। এদিকে এসে পড়ে ‘ত্রাণকর্তা’ আইএমএফ। তারা বলে তোমাদের হিসাবায়ন পদ্ধতি ভুল। তোমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ পরিমাপ করছ না। তোমাদের রিজার্ভ অনেক কম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রিজার্ভের পতন। ফল কী? ৩০-৪০ শতাংশ হারে টাকার মানের অবমূল্যায়ন। প্রচণ্ড মূল্যস্ফীতি। কারণ আমরা ‘রফতানি’ ‘রফতানি’ করতে করতে সবকিছুই আমদানি করি। এখন তো কাঁচামরিচও আমদানি হচ্ছে। এমন আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হলে অবশ্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। ভুগছি যখন আমরা, কে দায়ী এর জন্য? বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কোনো অফিসার/নির্বাহী এসব ভুল তথ্য সরকারকে দিয়েছেন। তারা তাদের চাকরি মজবুত করেছেন, পদোন্নতি নিয়েছেন, চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন। অথচ তারা কিন্তু জানতেন যে রিজার্ভের মূল্যায়ন/হিসাবায়ন পদ্ধতিটি আমাদের ভুল। এর পরও তারা অন্যায় কাজটি করেছেন। আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘ডুগডুগি’ বাজিয়ে তাদের কাজ হাসিল করে নিয়েছে।


রফতানির ক্ষেত্রে তো ঘটছিল মারাত্মক সব ঘটনা। ‘সম্ভাবনা’ ‘সম্ভাবনা’ দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা/রফতানিকারকরা একের পর এক সুবিধা নিচ্ছিল। এই কয়দিন আগেও বলা হয়েছে পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের রফতানি আয় হবে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। এখন কী হবে এসব রফতানি নীতির? কী হবে সব কৌশলের? জবাব কে দেবে? এ দেশে তো আমাদের জবাবদিহিতা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে বহুদিন ইচ্ছাকৃত ভুল করে শ্রেণীবিন্যাসের ফর্মুলা অনুসরণ করেছে। তারা বলত ‘প্রভিশন’ খারাপ ঋণের বিপরীতে নয়। প্রভিশন রাখতে হবে আমানতের বিপরীতে। অথচ ‘আমানত’ হচ্ছে ‘লায়াবিলিটি’। ‘লায়াবিলিটি’র বিপরীতে ‘লায়াবিলিটি’র তুলনা হয় না। এর হিসাব করতে হবে খারাপ ‘অ্যাসেট’ বা খারাপ ঋণের বিপরীতে। না, তা তারা দীর্ঘদিন ধরে করেনি। না করে ব্যাংক খাতকে একটি অরক্ষিত খাতে পরিণত করে। আসা যাক আমদানির ক্ষেত্রে। কেউ আমরা জানি না কত টাকার/ডলারের মাল আমদানি হয়। আমদানি বাড়তে বাড়তে একসময় তা ৮৫-৯০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সবার চক্ষু চড়কগাছ। কী হচ্ছে এসব? এত ডলারের আমদানি যাচ্ছে কোথায়? বাজারে তো এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। এরপর দেখা গেল অতিমূল্যায়ন (ওভার-ইনভয়েসিং) করে টাকা পাচার হচ্ছে সমানে। ১ টাকার মাল ২ টাকা দেখিয়ে আমদানি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা ধরেছে অনেক ক্ষেত্রে। এর পরও অতিমূল্যায়নের ঘটনা থেমে নেই। ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে টাকা পাচার/অর্থ পাচারের মূল মাধ্যম। ব্যাংকগুলো আবার হয়েছে ধনী ও অতিধনীদের বন্ধু। অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়িত ‘ইনভয়েসিং’-এর জন্য আমরা জানি না আমদানির সঠিক তথ্য কোনটি। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে চলছে ঝামেলা দীর্ঘদিন থেকে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও