প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য
চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের আমন্ত্রণে চার দিনের বেইজিং সফর সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২১-২২ জুন প্রধানমন্ত্রী এক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত গিয়েছিলেন। প্রভাবশালী এ দুই দেশের সঙ্গে অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে; ভারত ও চীনে পরপর রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্য দিয়ে তা আরও সংহত হবে, এমনটাই আশা করা যাচ্ছে। ভূরাজনৈতিক কারণে এবং অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফর বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রথমত, কারও অজানা নয় যে ভারত ও চীন উভয়েই দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সদা তৎপর। দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পরপরই চীন সফরে যাওয়ার মাধ্যমে দুটি দেশকেই সম্ভবত এই বার্তা দেওয়া গেছে; বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়– পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্র থেকে সরে আসবে না। ভারত ও চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের নিজস্ব বিষয় এবং বাংলাদেশ তার নিজ স্বার্থে দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখবে– প্রধানমন্ত্রী তা চীন সফরের আগেই স্পষ্ট করে বলেছেন।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে না পারায় বাংলাদেশ যখন একটি বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর, তখন চীন তাতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু ভারত সেখানে আপত্তি জানায়। ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা এক রিপোর্টে লিখেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এবং শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে হওয়ায় ভারতের জন্য তা অত্যন্ত সংবেদনশীল। কারণ, এই করিডোর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সংযোগ স্থাপন করেছে। সেখানে চীনের উপস্থিতি তাদের জন্য অস্বস্তির।
ভারত তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগে আপত্তি জানালেও তিস্তা চুক্তি কার্যকরে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরেও এ নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। তবে এ প্রকল্পে চীনের বদলে ভারত এখন বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনের বদলে ভারত কেন– এ নিয়ে অবশ্য সমালোচনা হচ্ছে। তবে একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করতে হবে, তিস্তা নদী যেহেতু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, তাই ভারতকে পাশ কাটিয়ে সেটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। চীনের সঙ্গে আলোচনার কারণে ভারতও যদি এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়, সেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে চীনের সঙ্গে আলোচনা চালু রাখা যেতে পারে বা ভারত-চীন যৌথ বিনিয়োগেও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে পারে, যা কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় প্রতীয়মান হবে।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে এই সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশকে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন এবং প্রযুক্তির অবদান রয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সম্পর্ক আরও মজবুত হলে দেশের উন্নয়নের গতি বাড়বে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’ এইআইর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রধানমন্ত্রীর সফরে চীনের সঙ্গে ২১টি সমঝোতা স্মারক সই ও ৭টি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফিজিবিলিটি স্টাডির সমাপ্তি ও দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি চুক্তির মতো বিষয়। চীনের এই নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।
তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর বাংলাদেশের বাণিজ্যিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং চীন থেকে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়।’ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা এবং এ ব্যাপারে সরকার গৃহীত কার্যক্রমও তুলে ধরেছেন। তাঁর আহ্বানের ফলে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা অত্যন্ত ইতিবাচক হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- চীন সফর
- প্রধানমন্ত্রীর সফর
- শেখ হাসিনা