অনিয়মই যদি নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়
আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু দৈনন্দিন কাজকর্ম সবারই করতে হয়। পথচলা থেকে শুরু করে সাংসারিক, ব্যক্তিজীবনে ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম করতেই হয়। সাধারণ কাজ যেটা আমরা সব সময় করি বা করতে বাধ্য হই, সেখানে আপনি একটু লক্ষ করলে দেখবেন, যেটা অনিয়ম, যেটা অন্যায়, সেটা নিয়মে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের কাজের উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হবেন, যদি রাস্তা পারাপার হতে হয়, প্রথমেই দেখবেন ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে যত্রতত্র মানুষ পারাপার হচ্ছে, এক হাতে মোবাইল কানে দিয়ে আরেক হাত উঁচু করে রাস্তা পার হচ্ছে অবলীলায়। জেব্রা ক্রসিং কোথায় আছে, এখন কেউ এটা খেয়াল করে না। যেখানে ওভারব্রিজ আছে, সেখানে ব্রিজের নিচ দিয়ে চলছে মানুষ হাত জাগিয়ে। গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে, কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই; অর্থাৎ রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো বালাই নেই, স্বেচ্ছাচারী অনিয়মটাই জীবন চলার পথে আমাদের নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আপনার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন, মাসে মাসে টাকা দেবেন, স্কুল থেকে আপনাকে বড় একটি তালিকা দেওয়া হবে করণীয় সম্পর্কে। তালিকায় থাকবে বই, খাতা, কাগজ, কলম কোনখান থেকে কিনবেন, ছেলেমেয়ের ইউনিফর্ম কত টাকা দিয়ে কোনখান থেকে কিনবেন, এসবের বিরাট একটি তালিকা পাবেন। কোন কোন সিলেবাস কোন কোন মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে, কোন কোন বিষয় কত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে—সবকিছুই লেখা থাকবে সুন্দর পরিপাটিভাবে। যা কিছু আছে, সবকিছুই আপনাকে কিনতে হবে।
স্কুলের মাইনা মাসে মাসে পরিশোধ করতে হবে ১০ তারিখের আগে, তারিখ পার হয়ে গেলে গুনতে হবে জরিমানা; অর্থাৎ স্কুল থেকেই আপনাকে সবকিছু ব্যবস্থা করে দেবে আপনার সন্তানের ভর্তির পর থেকে পরীক্ষার আগপর্যন্ত। তবে একটা কথা, শুধু পড়াশোনাটা স্কুল করিয়ে দেবে না, এটা আপনার কিনতে হবে প্রাইভেট টিউটর দিয়ে, এটাও কিন্তু নিজের বুঝে নিতে হবে স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে। হায়রে কপাল! বড় বড় স্কুলের কত কঠোর নিয়মকানুন, শুধু লেখাপড়াটা কিনতে হয় বাইরের টিউটরের কাছ থেকে!
সরকারি কোনো দপ্তরে যান। যেসব ব্যক্তি বসে আছেন কেরানি থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত, এখানে যাওয়ার পরে আপনার মনেই হবে না তারা কোনো সেবা প্রদানকারী সংস্থা। মুখ গোমড়া করে মারমুখো অবস্থায় বসে আছেন সবাই। আপনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পরে প্রথমেই এমন অবস্থা করা হবে, আপনি যে কাজের জন্য সেখানে গেছেন, সেটা করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন কথা বলবেন—সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠিয়ে দিতে পারবে, পূর্ব দিকে নমিত করতে পারবে, তবে আপনার কাজটি তার চেয়েও কঠিন, এটা করা প্রায় অসম্ভব। ঘাটে ঘাটে নির্দিষ্ট করে একটা চাঁদা আছে। কেরানি সাহেবের জন্য ধার্য আছে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা। পরের ধাপের জন্য একটু বেশি পরিমাণে, এর পরের ধাপের জন্য আরেকটু বেশি পরিমাণে।
এ রকম তিন-চার ধাপ পার হওয়ার পরে আপনার কাজ হতেও পারে, তবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা আপনাকে দিতেই হবে। অফিসের কর্তাব্যক্তিরা এর নাম দিয়েছেন ‘স্পিড মানি’। এখন এই ‘স্পিড মানি’ যেন আইনে পরিণত হয়েছে, আপনাকে এটা মেনেই সব কাজ করতে হবে। জমিজমা-সংক্রান্ত কোনো রেজিস্ট্রি অফিসে যান, দলিল মূল্যের ২ শতাংশ স্পিড মানি দিতে হবে। এটা হিসাব করা।
আপনি ঠিকাদারি করছেন—এলজিইডি, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, গণপূর্ত, পাবলিক হেলথ, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অথবা যেকোনো ঠিকাদারি কাজের। পদবি দপ্তর অনুসারে আপনার জন্য ঠিক করা আছে, আপনি কত টাকা কোন কোন পদের জন্য কাকে কাকে দেবেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ব্যক্তি জীবন
- দৈনন্দিন কাজ