টার্গেট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নাকি টেন্ডারবাজি
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতি চালুর জন্য সক্রিয় হয়েছে ছাত্রলীগ। এরই অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি এমন একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। যদিও ছাত্রলীগ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্থ সাউথসহ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করে। তবে ওই সময় এর বিরোধিতা করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়েছিল তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অনুমোদন দেওয়া হবে না। এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি এমন একটি সময়ে ঘটছে, যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা নিয়ে হইকোর্ট একটি রায় দিয়েছে। যদিও বুয়েটে রাজনীতি থাকা না-থাকা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তির’ মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। ওই ঘটনায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর সাজা হয়েছে। গত ২৭ মার্চ বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার প্রবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৯ মার্চ থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। এমন পটভূমিতে ছাত্রলীগের একজন নেতা ওই জরুরি বিজ্ঞপ্তির ওপর একটি রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ মার্চ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সেই ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র কার্যক্রম স্থগিত করে উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের ওই আদেশের পর রিটকারীর আইনজীবী আদেশের ব্যখ্যায় বলেছেন, আদালত ওই আদেশ স্থগিত করেছে মানে হচ্ছে বুয়েটে রাজনীতিতে বাধা অপসারণ হলো; অর্থাৎ বুয়েটে রাজনীতি করতে আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু আসলে কি তাই?
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দুই ধরনের মন্তব্য এসেছে। কেউ বলছে, ১৯৬২ সালের বিধিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা আছে। আবার কেউ বলছে, বুয়েটে শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ আছে কিন্তু ছাত্ররাজনীতি নয়। কেউ কেউ এ-ও বলছে, এ-সম্পর্কে বিধিতে কিছু নেই। অবশ্য বিধির একটি ধারায় বলা আছে, The teachers and employees of the University shall neither seek nor contest election of any legislature or local body. আবার উইকিপিডিয়ায় আছে, ‘অধ্যাদেশ ১৯৬২ অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ মূলত হাইকোর্ট ২০১৯ সালে বুয়েট কতর্ৃৃপক্ষের একটি সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে। ১৯৬২ সালের অধ্যাদেশ স্থগিত বা বাতিল করেনি। ফলে অধ্যাদেশে যদি সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা উল্লেখ থাকে, তবে তা এখনো নিষিদ্ধই আছে। কেননা বুয়েট পরিচালিত হয় ১৯৬২ সালের বিধি অনুসারে। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর বুয়েটের ভিসি জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে উত্তপ্ত ক্যাম্পাস শান্ত করার কৌশল নিয়েছিলেন মাত্র। ওই সিদ্ধান্ত হাইকোর্টে স্থগিত হওয়া মানে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনীতি ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হওয়া নয়। কিন্তু আদালতের রায় ঘোষণার পর ছাত্রলীগের নেতারা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছেন এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন। যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
প্রথমে যে কথা দিয়ে আলাপ শুরু করেছিলাম ছাত্রলীগ এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ানো ও পুনর্বিন্যাস করার কথা ভাবছেন। বর্তমানে দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইতিমধ্যে ৩৯টিতে ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি বা ইউনিটগুলোর তত্ত্বাবধান করার জন্য ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২৩ সদস্যের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিও গঠন করেছিল ছাত্রলীগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কমিটি গঠনসহ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনাকে ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ হিসেবে তুলে ধরছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলেও এ পর্যন্ত কোনো ক্যাম্পাসেই কোনো ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেখা যায়নি। কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের করা ১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন দিয়ে, যা ২০১০ সালে সংস্কার করা হয়। এই আইনে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে প্রশাসনের বিভিন্ন কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। আইনের ৬ (১০) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হইতে পারে এমন কোনো কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিবে না বা সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতা বা এই জাতীয় কোনো কার্যকলাপে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করিবে না।’