একনায়ক বা স্বৈরশাসকের পতন স্বাভাবিক বা শান্তিপূর্ণ হয় না। তাকে উৎখাত করতে হয়। বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থান বা ক্যু—এগুলোই পথ।
চার্লস টিলি বা ফ্রাঞ্জ ফানোঁর মতো সমাজ ও রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের কথা ধার করে বলা যায়, সহিংসতা ও সংঘাতের পথেই যেহেতু রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, তাই রাষ্ট্রের রাজনীতিতেও ধারাবাহিকতা হিসেবে সহিংসতা টিকে থাকে। বিশেষ করে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া রাষ্ট্র বা স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দেশগুলোতে সহিংসতা উত্তরাধিকার হিসেবেই থেকে যায়। এমন একটি রাষ্ট্রে যখন স্বৈরাচার চেপে বসে, তখন তাকে সরানোর পথটিও হয় সহিংস।
হাসিনার পতন হবে, এটা জানাই ছিল। কিন্তু জানা ছিল না কবে ও কীভাবে তা ঘটবে। সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে এই আশঙ্কাও ছিল যে হাসিনার উৎখাত-পর্ব হতে পারে রক্তাক্ত।
বিএনপিসহ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ১০–১১ বছর ধরে এই শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করেছে। তখনো রক্ত ঝরেছে। গুম, খুন ও নানা কায়দার দমন–নিপীড়ন চালিয়ে হাসিনা তা দমন করেছেন।
বিএনপির দীর্ঘ সরকার পতনের আন্দোলন সফল হয়নি। কারণ, শুধু দলের নেতা-কর্মীদের আন্দোলন দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন বা গণ-অভ্যুত্থান ঘটানো যায় না। জনগণের অংশগ্রহণ লাগে। মানুষ হাসিনার পতন চাইলেও বিএনপি তাদের আন্দোলনের সাথি করতে পারেনি। পারলে তারাই হতো গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া দল।
দেশের মানুষ স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল, আবার বিএনপির পেছনে জড়ো হওয়ার ভরসাও পাচ্ছিল না। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে, তখন সাধারণ মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। অরাজনৈতিক সেই আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা ও তীব্রতা সরকারের মনে পতনের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। তারা কোনো ঝুঁকি নেয়নি, আন্দোলন দমনে তারা পুলিশের পাশাপাশি কাজে লাগায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের হেলমেট বাহিনীকে।
সহিংসতার শিকার স্কুল-কলেজের সেই শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক ও জনতা ঘরে ফিরলেও তারা অপেক্ষায় ছিল। ছয় বছর পর আবারও শিক্ষার্থীরাই সেই সুযোগ তৈরি করে।
অরাজনৈতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনে অসমসাহস নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন স্বৈরাচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, তখন মানুষ তাদের পেছনে জড়ো হতো শুরু করে। দেশের মানুষ হাসিনা উৎখাতের আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য এমনই একটি শক্তির অপেক্ষা করছিল। একই সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও মাঠে নামে।
এবার জনগণ আর কোনো পরিণতি ছাড়া ঘরে ফিরতে রাজি ছিল না। ৫ আগস্ট দেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি বা দলের অধীনে বা কোনো আদর্শের ভিত্তিতে বিপ্লব হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার বিদায়, স্বৈরশাসনের অবসান। সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।
৫ আগস্টের পরের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নিয়ে এ বছর ১৫ জানুয়ারি প্রথম আলোতে লেখা এক কলামের শিরোনামেই প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘হাসিনার পতন নিয়েই কি খুশি থাকতে হবে’।
গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সম্ভবত এর উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ৫ আগস্ট যেহেতু দেশে কোনো বিপ্লব হয়নি, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী, সহযোগী রাজনৈতিক দল ও শক্তি এবং সাধারণ মানুষের মনে হাসিনাকে উৎখাত করা ছাড়া আর কোনো দূর-চিন্তাও তাই ছিল না। সরকার গঠন নিয়ে বিভ্রান্তিসহ ৫ আগস্টের পরের ঘটনাবলিই এর প্রমাণ।
তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা অনেকেই বলতে শুরু করেছি যে গণ-অভ্যুত্থানের কিছু আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আকাঙ্ক্ষাগুলো কী? কে তা ঠিক করে দিয়েছে?
শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচন বিষয়টি হারিয়ে গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন তাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি বড় আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এর বাইরেও ‘গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা’ হিসেবে আরও কিছু বিষয় সামনে চলে এসেছে। এগুলোর অধিকাংশই আমরা পেয়েছি গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরের দেয়াললিখন থেকে। আর ১৫ বছর ধরে যেভাবে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস হতে দেখেছি, সেগুলো মেরামত করার আকাঙ্ক্ষা আমাদের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে।
এ সময় আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, তার মুখোমুখি যেন আমাদের সামনে আর হতে না হয়; অর্থাৎ ভবিষ্যতে স্বৈরশাসন যেন আর কোনোভাবে কেউ কায়েম করতে না পারে, সেই পথ বন্ধ করার আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়েছে। আমরা ভেবেছি, সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারব।