
রবীন্দ্র রচনায় বাংলাদেশ
রবীন্দ্র রচনার প্রায় সব প্রাঙ্গণ জুড়ে কোনো-না-কোনোভাবে বাংলাদেশের মাটি-মানুষ-প্রকৃতি স্থান করে আছে। অবিভক্ত বাংলার নাগরিক হিসেবে তো বটেই, কৌলিক বিচারেও তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের রক্তের উত্তরাধিকার। বিবাহ-সূত্রেও তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। কর্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশের বাসিন্দা। বাসিন্দা মানে কেবল প্রজা নয়, জমিদার। শ্রেণিবিচারে শাসক। আর রচনার পটভূমি এবং রচনা স্থান হিসেবেও কবি বাংলাদেশকে অবলম্বন করেছেন বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই।
রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ বিষয়ে বেশকিছু গবেষণা ইতিমধ্যে হয়েছে। কিছু গবেষণা গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত। আমারা দেখতে চাই, রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন স্থানের নামকে কতবার কতভাবে উচ্চারণ করেছেন।
আমরা প্রথমেই বলে নিতে চাই যে, রবীন্দ্র রচনায় অর্থাৎ গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণ-এ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি এসেছে ৩৯৭ বার। এরপর ত্রিপুরা/কুমিল্লা এসেছে ৪৩ বার। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের নাম যেমন কুষ্টিয়া ২৩বার, বরিশাল ১৭ বার, রাজশাহী ৯ বার, পাবনা ৭ বার, খুলনা ৫ বার, ময়মনসিংহ ৪ বার, রংপুর ৩ বার, পতিসর ৩ বার, নাটোর ২ বার, বগুড়া ১ বার, ফরিদপুর ১ বার। বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মা ২৭ বার এসেছে।
বাংলাদেশ শব্দটি তিনি যে ৩৯৭ বার উচ্চারণ করেছেন তার বিভিন্ন রচনায়। তার কিছুটা নমুনা আমরা উদ্ধার করতে পারি: ‘চেঁচিয়ে বলা’ নামের এক প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন—
‘গোটাকতক ইংরাজি শব্দ আসিয়া আমাদের অতিশয় অনিষ্ট করিতেছে। Independent Spirit নামক একটা শব্দ আমাদের সমাজে বিস্তর অপকার করিতেছে-- বাঙালির ছেলেপিলে খবরের কাগজপত্র সকলে মিলিয়া এই Independent Spirit-এর চর্চায় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। এই শব্দটার প্রভাবে প্রতিমুহূর্তে বাংলাদেশ হইতে সহজ ভদ্রভাব চলিয়া যাইতেছে ও এক প্রকার অভদ্র উদগ্র পুরুষ ভাবের প্রাদুর্ভাব হইতেছে। খবরের কাগজের লেখাগুলার মধ্যে আগাগোড়া এক প্রকার অভদ্র ভঙ্গি দেখা যায়। ভালো মুখে মোলায়েম করিয়া কথা কহিলে যেন Spirit-এর অভাব দেখানো হয়--সেইজন্য সর্বদাই কেমন তেরিয়াভাবে কথা কহিবার ফেসিয়ান উঠিয়াছে--অনর্থক অনাবশ্যক গায়ে পড়িয়া অভদ্রতা করা খবরের কাগজে চলিত হইয়াছে।’
বাংলাদেশের সহজ ভদ্রভাব চলে যাওয়ার আশঙ্কায় উদগ্রীব ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই প্রকাশ করেছেন এই প্রবন্ধ।
রবীন্দ্রনাথ যে শান্তিনিকতেন গড়ে তুলেছেন, তার পটভূমি যে প্রাকৃতিক নিসর্গ, সেই বিষয়ে আমরা অবগত। তিনি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ নামের এক প্রবন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রূপরেখা অঙ্কন করেছেন তাতেও দেখা যায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গের অবতারণা। তিনি লিখেছেন—
‘কেউ কেউ তথ্য গণনা করে দেখিয়েছেন, পূর্বকালে এ দেশে গ্রাম্য পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষার যে উদ্যোগ ছিল ব্রিটিশ শাসনে ক্রমেই তা কমেছে। কিন্তু, তার চেয়ে সর্বনেশে ক্ষতি হয়েছে, জনশিক্ষাবিধির সহজ পথগুলি লোপ পেয়ে আসাতে। শোনা যায়, একদিন বাংলাদেশ জুড়ে নানা শাখায় খাল কাটা হয়েছিল অতি আশ্চর্য নৈপুণ্যে; হাল আমলের অনাদরে এবং নির্বুদ্ধিতায় সে-সমস্ত বদ্ধ হয়ে গেছে বলেই তাদের কূলে কূলে এত চিতা আজ জ্বলেছে। তেমনি এ দেশে শিক্ষার খালগুলোও গেল বদ্ধ হয়ে, আর অন্তর-বাহিরে সমস্ত দীনতা বল পেয়ে উঠেছে। শিক্ষার একটা বড়ো সমস্যার সমাধান হয়েছিল আমাদের দেশে। শাসনের শিক্ষা আনন্দের শিক্ষা হয়ে দেশের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল, মিলেছিল সমস্ত সমাজের প্রাণক্রিয়ার সঙ্গে। দেশব্যাপী সেই প্রাণের খাদ্যে আজ দুর্ভিক্ষ। পূর্বসঞ্চয় কিছু বাকি আছে, তাই এখনো দেখতে পাচ্ছিনে এর মারমূর্তি।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রয়াণ দিবস
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর