চৈত্রের সংক্রান্তির দিনে পাহাড়েও বৈসাবি উৎসব
উৎসব হলো সভ্যতার নিয়ামক। মানব জাতির ইতিহাসে এ উৎসব সময়ের হাত ধরে আজকের পর্যায়ে এসেছে। খ্রিস্ট ৩৫০০ বছর পূর্বে আর্যগোষ্ঠীর হিন্দি স্লাভভাষী মানবকুলে সর্বপ্রথম উৎসবের সূচনা ঘটে। সোমরস, সঙ্গীত, নৃত্য, বাজন ও একত্রিত হওয়াকে উৎসবের দেহ বলা হয়। প্রকৃতির দান পুষ্পের বাহারি-ব্যবস্থারও শুরু হয় তখন। তার ১৫০০ বছরের পর বক্ষুতটে (অক্সাসের তীরে) স্বাত উপত্যকায় অতীতের পুরু-জনের প্রথানুযায়ী পশু পালের সেরা ঘোড়াটি বলি দেওয়া হতো, যা ইন্দ্রপূজার বলি হিসেবে বিদিত। এতে মানুষের আমিষের চাহিদাও পূরণ হতো নতুবা গায়ে অত জোর আসবে কেন? বছরের বসন্ত শেষে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে নারী পুরুষ, যুবক-যুবতী সকলে অংশ নিতো। এতে গোমাংস, সোমরস, মধু, ভাঙ, ফুল, নাচ উপস্থাপন করা হতো। নারীরা স্বর্ণালঙ্কারসহ বসন-ভূষণে সজ্জিত হওয়া, প্রণয় কামনা পূরণ, রজনীভোগসহ এক সামগ্রিক আনন্দ প্রকাশিত হতো এ উৎসবে। (রাহুল সাংকৃত্যায়নের 'ভোলগা থেকে গঙ্গা' এর ২য় পরিচ্ছেদ-দিবা ও ৫ম পরিচ্ছেদ-পুরুধান দ্রষ্টব্য)। ভোলগারের মানবগোষ্ঠীর এ উৎসবের মালিকানা হাজার হাজার বছর ধরে ছড়িয়ে এসেছে মানুষের থেকে মানুষে যুগ-যুগান্তর। কালক্রমে গঙ্গাবাহিত মানবগোষ্ঠীর নানা শাখায় প্রবিষ্ট হয়েছে নানা স্থানে। উৎসবের বাহ্যিক রূপ নানা আঘাতে হয়তো বদল হয়েছে কিন্তু তার মূল বৈশিষ্ট্য থেকে গেছে অক্ষত।
চীনের বসন্ত উৎসব ও চান্দ্রবর্ষের ড্রাগন নৃত্য, ভিয়েতনামের চান্দ্রবর্ষের তেত উৎসব, মিয়ানমারে ছিংগ্যেয়েন এক একটি মাইলফলক। এদিকে আমাদের বাংলাদেশে সনাতনী ধারার বাঙালিদের চিরায়ত চৈত্র সংক্রান্তির সমসাময়িক পার্বত্য চট্টগ্রামেও বিভিন্ন নামে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। যেমন- বিঝু, বিষু, বৈসু, সাংগ্রাই, চংক্রাণ নানা নামে পরিচিত। উৎসবের আয়োজন, আমেজ, মেজাজ মূলত: খাদ্য, আবাসন, স্মরণ, নিবেদন বা বন্দনা ও মূল্যায়ন। এ সব কৃত্যগুলো সম্পন্ন হয় সাধারণত আনন্দের মধ্যে দিয়ে, উল্লাসের মধ্যে দিয়ে। সাধারণভাবে অধুনা এটাকে আমরা নাম দিয়েছি সামাজিক উৎসব। দ্বিতীয়ত পাহাড়িদের সাধারণ চরিত্র হলো- তারা আমোদপ্রবণ ও উৎসবপ্রিয়। তাই তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় যে কোনো অনুষ্ঠান উৎসবের রূপ নেয়। জানা যায়, বিগত সময়ে রামগড় মহামুনি ও খাগড়াছড়ি য়ংড বিহারে অনুষ্ঠিত বৌদ্ধ মেলাগুলো ১৫ দিন থেকে ১ মাসব্যাপী চলেছে। এতেও আয়োজকদের খায়েশ পূরণ হয় না, তারা আরও প্রলম্বিত করতে চাইলে স্থানীয় ও বিহার কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে পুলিশের সহায়তা নিয়ে এগুলো বন্ধ করতে হয়েছিল।
প্রবল শীতের পর এখানে ফাগুন মাসে রাশি সংক্রমণের সাথে সাথে উত্তরীয় বায়ু প্রবাহ শুরু হয়। প্রকৃতি তখন সজীব হয়ে উঠে। গাছে গাছে ফুল-ফল আসে। কিছু প্রজাতির গাছে পাতা ঝড়ে যায়, নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে। প্রকৃতির শক্তি বলে কথা! বনে নানা রকমের পাখি লোকালয়ে পর্যন্ত চলে এসে জানান দিতে থাকে। এদের প্রজননকালও শুরু। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে জনপদগুলো। পাহাড়েও একটা তাড়া শুরু হয়ে যায়। বাৎসরিক আয়োজনের জন্য গ্রামে গ্রামে একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কাজে-কর্মে, মননে কী এক তাগিদ দেখা দেয়। অর্জনের হিসাব নিকাশ, ক্লান্ত মনে নিজের অবয়ব ফিরে দেখার তাগাদা অনুভূত হয়। তার জন্য বাড়তি কিছু দায়িত্ব ঘাড়ে এসে চাপায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈসাবি উৎসব
- চৈত্র সংক্রান্তি