নারী তার প্রাপ্য মর্যাদা পাক
নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজের প্রায় সকল স্তরেই। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, পরিবহন, রাস্তাঘাট—কোনো জায়গাই বাদ পড়ছে না এই সহিংসতার ছোবল থেকে। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে এবং সেটা প্রতিনিয়ত। কোনো কোনো সংবাদ পত্রিকায় আসে, কোনো সংবাদ বোবাকান্নায় চাপা পড়ে যায়, কোনো কোনো সংবাদ আবার ক্ষমতার প্রতাপ ও প্রভাবে আড়ালে চলে যায়। যেগুলো পত্রিকার পাতায় আসে, সেগুলোই সাধারণ সচেতন মানুষ জানতে পারে, কথা বলে, প্রতিবাদে মুখর হয়। বাকি সংবাদগুলো নিয়মের বাকিতে চলে যায়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতার সঠিক ও প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই সবের কোনো প্রতিবাদ বা বিচারের দাবি ওঠে না। এতে যে নারী নির্যাতনের শিকার হয়, তার নীরব প্রস্থান ঘটে হয়তো এ জগৎ থেকে। এটা ঠিক যে, নারীর অধিকার বিষয়ে কোনো কোনো পরিবার ও নারী সচেতন হলেও গোটা সমাজ এখনো সার্বিকভাবে সচেতন হতে পারেনি, যা দৃশ্যমান হয় বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এবং কার্যক্রমে। নারীর অবস্থান যেখানে বিবেচনার শিরোনামে প্রকাশ ও নির্ধারিত হয়। জাতীয় শিক্ষা ও নারীশিক্ষার মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলেও আজও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ভাবা ও অধীনস্থ করে রাখার মনমানসিকতা সমাজে বিদ্যমান। সে কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ে, কমে না।
ন্যায়বিচার চাইতে যাওয়াটা অনেকের কাছেই রীতিমতো আতঙ্ক। সাধারণত দেখা যায়, একবার নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ন্যায়বিচার চাইতে গেলে তাকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্যাতনের শিকার হতে হয়। প্রথমবার নির্যাতনের সঙ্গে দ্বিতীয়বার নির্যাতন হওয়ার মধ্যকার মূল পার্থক্য হলো, প্রথমবার সে প্রকৃত নির্যাতনকারীর কাছে নির্যাতিত হয়। আর দ্বিতীয়বার নির্যাতিত হয় যার কাছে বিচার চাইতে গেল, সেই শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা বিচারক (!) ব্যক্তির কাছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যেন নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখার পাঁয়তারা থেকেই যায়। পুরুষ হয়ে ওঠে সিস্টেম। ফলে আইন, অধিকার আড়াল হয়ে পড়ে। ওসব কোনো কাজে আসে না। পুলিশের একটি গবেষণায় এমন তথ্য এসেছে যে, নির্যাতিত নারী বিচার চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়। অনেকটা দ্বিতীয়বার নির্যাতনের শিকার হওয়ার মতো।
নারী প্রথমে যে জায়গায় যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয়, সেটি হলো তার পরিবার। একজন মা বলছিলেন, যেদিন তিনি জানতে পারেন তাঁর গর্ভে একজন কন্যাশিশুর অস্তিত্ব, সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে অবস্থান নেবেন। কারণ, তিনি তাঁর কাজের সুবাদে এমন অনেক ঘটনা জেনেছেন, যেখানে পরিবারে একজন কন্যাশিশু তার পরিবারের পুরুষ সদস্য বা আত্মীয়স্বজন দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। মা তাঁর আগত কন্যাশিশুকে নিয়ে এমন তিক্ত ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান না। তাই একান্নবর্তী পরিবারের গণ্ডি থেকে বের হতে চেয়েছেন। অভিজ্ঞতা ব্যক্তিকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে বিধায় একজন মায়ের এমন সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বা ভুল বলা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর পরও কি একটি কন্যাশিশু তার পরিবারে নিরাপদ হতে পারছে বা থাকছে? উত্তর, না। এমন সিদ্ধান্তের দ্বিমত পোষণকারীরা বলেন, একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারে সন্তানেরা নিরাপদ বেশি। কারণ, বাবা ও মা কর্মজীবী হলে পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের সন্তানদের দেখভাল করতে পারে, চোখের নজরে রাখতে পারে। কিন্তু একক পরিবারে বাবা ও মা কর্মজীবী হয়ে থাকলে পরিবারের সহায়তাকারী পুরুষ, যেমন—ড্রাইভার, দারোয়ান, সাপোর্ট স্টাফ দ্বারা কন্যাশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে। তাঁরা আরও মনে করেন যে, সমস্যা একক বা যৌথ পরিবারের নয়; সমস্যা হলো, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষার অভাব।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নারী
- যৌন হয়রানি
- সম্মান
- নিপীড়ন