উন্নতির বিপদ ও ভুলে যাওয়া ফেলানী
‘উন্নতি’ যে আমাদের বিপদে ফেলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই উন্নতির গাড়ির নিচে পড়েই তো লক্ষ্মীপুরের শফিউল্যা প্রাণ হারিয়েছেন। আর আমাদের নদীগুলোর পক্ষে বেঁচে থাকাটা ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়ছে। জলাশয়ের সংখ্যা কমছে, প্রতিদিন। সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৪৪ জন মানুষ। এ ঘটনায় ভবন মালিক ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম না মানার কথা জানা যাচ্ছে। আবার একটি বহুতল ভবনে একাধিক রেস্টুরেন্ট থাকা নিয়েও যে সমালোচনা চলছে- তার সঙ্গে লেখার প্রথমে উল্লিখিত ‘উন্নতির বিপদও জড়িত’। তাছাড়া, ঢাকা শহরে অগ্নিকা-ের ঘটনা তো নতুন নয়। আগুন লেগে গেলে সেটা নিয়ন্ত্রণে পানিরও প্রয়োজন পড়ে। জরিপ বলছে গত ২৮ বছরে ঢাকা শহরে জলাশয় কমেছে ৮৫ শতাংশ; সবুজ এলাকা সঙ্কুচিত ৪৫ শতাংশ। এদের বিপরীতে নির্মাণ এলাকা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। আর দেশের মানুষ? নতুন দরিদ্রের সংখ্যা তো ক্রমবর্ধমান।
আমরা স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু মুক্তি আসেনি, নানাবিধ নিরাপত্তাও দেওয়া সম্ভব হয়নি। নাগরিক জীবনের দুর্ঘটনা তো আছে, সেই সঙ্গে বলতে হয় আমাদের সীমান্তবর্তী প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা। সীমান্ত প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন ধরা যাক ফেলানীর কথাও। ফেলানীকে ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। ফেলানী কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নয়, অতিসামান্য একজন কিশোরী; কিন্তু ফেলানী একজন নয়, অনেকজন, বসবাস যাদের বাংলাদেশের সীমান্তে। ফেলানী মারা গেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে, যেমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে, এবং ঘটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফেলানীর মৃত্যুকে ভুলে যাওয়াটা আবার সহজও নয়, এবং ঠিকও নয়। কেননা তার মৃত্যু একটি প্রতীকী ঘটনা বটে। ঘটনাটা সেভাবেই দেখা হয়েছিল যখন তার মৃত্যু ঘটে, কয়েক বছর আগে, ২০১১ সালে।
ফেলানী প্রতীক স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের ও বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনে স্বাধীনতার অভাবের; এবং একই সঙ্গে, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের ভেতরে তৈরি হওয়া ফারাকেরও। ঘটনার পরে, গণমাধ্যমে যখন হতভাগী ফেলানীর ছবি বের হয়েছে সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের বেড়াতে ঝুলন্ত অবস্থায়, আমরা তখন চমকে উঠেছিলাম, এবং ঘটনাটি নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। ফেলানীর মৃত্যুর প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে কবিতাও রচিত হয়েছে। কিন্তু তাকে তো আমরা আবার মনেও রাখিনি। না-রাখার অনেক কারণ। একটা হচ্ছে অমন ঘটনা বিরল নয়, ব্যতিক্রমও নয়। তাছাড়া আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে উদয়াস্ত ভীষণ ব্যস্ত থাকি, এত ব্যস্ত যে অন্যকিছু নিয়ে ভাববার ফুরসতই পাই না।
ফেলানীকে ভুলে যাওয়ার আরও একটি কারণ অবশ্য রয়েছে। সেটা হলো কিশোরী মেয়েটি একেবারেই প্রান্তিক অবস্থানে ছিল। পারিবারিকভাবে ফেলানীরা দারিদ্র্যসীমার প্রান্তবর্তী মানুষ। আবার ভৌগোলিক দিক থেকেও ফেলানীরা থাকে বাংলাদেশের একেবারে শেষ প্রান্তে; উত্তর দিকের সীমান্তে। এলাকাটি দুর্গম। নিতান্ত বাধ্য না হলে বাইরের মানুষ ওদিকে পা বাড়ায় না। ফেলানীরাও বাইরের জগতের খবর রাখে না। তাদের বসবাসের জায়গাটিতে রাস্তাঘাট নেই, বিদ্যুৎও পৌঁছায়নি। ছেলেরা তবুও কেউ কেউ বাইরে ছুটে যায় জীবিকার সন্ধানে; মেয়েরা সেটাও পারে না, ব্যতিক্রম ছাড়া।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ফেলানী হত্যাকাণ্ড