-6887ffabbfad7.jpg)
নিভে গেল নকশাল আন্দোলনের শেষ শিখাটিও
১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া ভারতের নকশাল আন্দোলন গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে বছরের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার নকশালবাড়ি গ্রামে পুলিশের গুলিতে মারা যায় দুই শিশুসহ ১১ জন। জোতদার ও পুলিশের যৌথ অত্যাচারের বিরুদ্ধে নকশালবাড়ি আন্দোলন সশস্ত্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনে যোগ দেন হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষিত তরুণ, কৃষক, মজুর। চীনের পিকিং রেডিও নকশালবাড়ির উত্থানকে ঘোষণা করে ‘ভারতের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ শিরোনামে।
ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্বর অত্যাচার এবং নাগরিক সংস্কৃতির ‘বাবু কমরেড’দের সুবিধাবাদী আচরণের কারণে সম্ভাবনাময় নকশাল আন্দোলন বৈপ্লবিক বিজয় অর্জনের বদলে পরাজয়ের দিকে ধাবিত হয়। সেই আন্দোলনের শেষ অগ্নিশিখা কমরেড আজিজুল হক কলকাতার বিধাননগরের এক হাসপাতালের সফেদ বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন মৃত্যুর শেষযাত্রায়। ২১ জুলাই তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তার চিরবিদায় শুধু এক ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান নয়, এক সংগ্রামী চেতনার অবসান।
আজিজুল হক ছিলেন নকশাল আন্দোলনের অন্যতম নেতা, যে আন্দোলন ছিল ভারতের বঞ্চিত, শোষিত শ্রেণির দীর্ঘস্থায়ী বেদনার সশস্ত্র প্রকাশ। তাদের পথ ছিল সহিংস। এ আন্দোলন সমাজে জমির প্রশ্ন, কৃষকের অধিকার ও শ্রেণিবৈষম্যের মতো ইস্যুগুলোকে সামনে এনেছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে এর প্রভাব আজও অনুভূত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয়।
নকশাল আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দরিদ্র গ্রামীণ এলাকা নকশালবাড়ি থেকে। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষকের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের অবসান এবং একটি বিপ্লবী সমাজ গঠন। এর নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, আজিজুল হক, জঙ্গল সাঁওতাল ও অন্যান্য বিপ্লববাদী বামপন্থি। আন্দোলনের আদর্শ ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদভিত্তিক।
নকশাল আন্দোলনে চীনের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। এ প্রভাবকে বোঝা যায় তিনটি প্রধান দিক থেকে-
১. মাওবাদী আদর্শের প্রভাব : নকশালপন্থিরা চীনের নেতা মাও সেতুংয়ের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিশেষ করে ‘মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লব’, ‘গ্রাম থেকে শহরের দিকে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়া’-এসব ধারণা নকশালপন্থিরা গ্রহণ করেন। তারা মনে করতেন, ভারতের বাস্তবতায় এ মাওবাদী পথই সঠিক বিপ্লবের রূপরেখা।
২. রাজনৈতিক সমর্থন : চীন আনুষ্ঠানিকভাবে নকশালপন্থিদের অস্ত্র বা সরাসরি সহায়তা দেয়নি বলে জানা যায়, তবে আন্তর্জাতিক বামপন্থি বিপ্লবী আন্দোলনের অংশ হিসাবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নকশাল আন্দোলনকে আদর্শগতভাবে সমর্থন করেছিল। চীনের কিছু পত্রিকায় ও বক্তব্যে এ আন্দোলনের প্রশংসা পাওয়া যায়। নকশালপন্থিরাও সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে চীনের প্রতি পক্ষপাত দেখান।
৩. ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব : ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অবনতির ফলে ভারতের সরকার চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা চীনা আদর্শে অনুপ্রাণিত যে কোনো গোষ্ঠীকে শত্রু হিসাবে দেখত। ফলে নকশাল আন্দোলনকারীদের প্রতি দমনপীড়ন আরও বেড়ে যায়। এবং তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্দয় আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে অকাতরে রক্ত দিতে হয়।
সামগ্রিকভাবে, নকশাল আন্দোলন ভারতের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থি গণ-আন্দোলন, যা চীনের মাওবাদী আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। যদিও আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক বা সামরিক সহযোগিতা ছিল সীমিত, তবুও আদর্শগত স্তরে চীনের প্রভাব ছিল গভীর ও অনস্বীকার্য। এটি ভারত-চীন সম্পর্ক ও উপমহাদেশীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। জেলখানায় নির্যাতিত হয়ে মূল নেতা চারু মজুমদারের মৃত্যু, কিছু বামপন্থির আপসকামিতা এবং সরকারি নিপীড়নে আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ‘নকশালবাদ’ রাজনৈতিক মতাদর্শ রূপে ব্যাপক আলোড়ন জাগাতে সক্ষম হয়েছিল।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম মুখ সদ্য প্রয়াত আজিজুল হকের জন্ম ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার রণমহল গ্রামে। বিশাল জমিদারি ছিল তাদের। রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে নিজের বাবার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে গরিবদের মধ্যে জমি বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। জীবনভর ছিলেন একজন লড়াকু, সংগ্রামী নেতা। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। আপস বা আত্মসমর্পণ করেননি। নীতির পথ থেকে ভ্রষ্ট হননি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্দোলন
- সশস্ত্র লড়াই