১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি ঐতিহাসিক সংগ্রামে ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছে এবং ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ডাকসু প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তফসিল ২৯ জুলাই ঘোষণা করা হবে এবং ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। সেই অনুযায়ী ঢাবি প্রশাসন বেশ কিছু প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে, যেমন গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন, আচরণবিধি ঠিক করা এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকেও নজর দেওয়া।
ইতিমধ্যে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি সাত সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধি রয়েছেন। তবে অতীতে এ রকম উদ্যোগ অনেকবার দেখা গেলেও নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তাই এখনো অনেক শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন, এবার কি সত্যিই নির্বাচন হবে, নাকি আগের মতোই আশার বুদ্বুদ মিলিয়ে যাবে?
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যে একধরনের অনীহা লক্ষ করা গেছে, যার ফলে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৯ বার নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৭ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯১ সালের পর থেকে ডাকসু নির্বাচন একেবারে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের কারণে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে; অর্থাৎ একানব্বই–পরবর্তী সময়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতন্ত্রচর্চার গলা চেপে ধরা হয়।
বারবার থমকে যায় ডাকসু নির্বাচন
পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ১৯৯০ সালের পর, ১৯৯১ সালের ১৮ জুন ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় সহিংসতার কারণে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচন হয়নি।
১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী উপাচার্য হওয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৯৮ সালে ডাকসু কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল; কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। মাঝেমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন এবং সিনেটে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও এসেছে। তবে তাতে কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
২০০৫ সালে ডাকসু নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করলেও, ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচনটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই সময় ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করলেও, ছাত্রলীগের প্রতিরোধের কারণে তাদের দাবি বাস্তবায়িত হয়নি।
এরপর ২০১২ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের
দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ তৈরি করা হয় এবং লাগাতার আন্দোলনও চলে বেশ কিছুদিন। তবে নির্বাচনের দাবি উঠলেও তা খুব জোরালো হয়নি।