-6887ed4b81bdb.jpg)
চাকরি আইন প্রণয়নে অদক্ষতার ছাপ
সরকার ও সরকারি কর্মচারীর সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক নয়, সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এবং মর্যাদা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (৩৩ ডিএলআর)। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এর দফা (২) অনুসারে সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হলে ওই আইনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ বাতিল হবে। অন্যান্য আইনের মতো সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত আইনও যেন সংবিধানের কোনো বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, সেজন্য আইন প্রণয়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা থাকতে হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন সে দক্ষতা দেখাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। চাকরিবিষয়ক আইন প্রণয়নে অদক্ষতার ছাপ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সুবিধাবাদী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা গোষ্ঠীস্বার্থ আদায়ের জন্য যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলনে জনস্বার্থ ও জনসেবা ব্যাহত করতে থাকলে জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া সরকারের কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বিগত সরকার ৪০ বছর ধরে বহাল থাকা ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ বাতিল করায় আন্দোলকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোনো আইনগত সুযোগ সরকারের কাছে ছিল না। এ কারণে সরকার বাধ্য হয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে রহিতকৃত ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটির অনুরূপ নতুন ৩৭ক ধারা সংযোজন করে গত ২৫ মে সরকারি চাকরি আইনের সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করে। কিন্তু জারিকৃত অধ্যাদেশটির ব্যাপক অপপ্রয়োগের আশঙ্কা ছাড়াও গুরুতর কিছু ভুল-ত্রুটি থাকায় এবং কতিপয় ক্ষেত্রে তা সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং অধ্যাদেশটি বাতিলের জন্য আন্দোলন দানা বাঁধে। সরকার আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসে এবং অধ্যাদেশটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে। উচ্চপর্যায়ের ওই কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত অধ্যাদেশটি একটি মানসম্মত ও ভালো অধ্যাদেশ হবে এবং তা সংবিধানের বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না এবং গুরুতর ভুল-ত্রুটিও থাকবে না, এটা সবাই আশা করেছিল। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত অধ্যাদেশটি গত ২৩ জুলাই জারি হলে তা সবাইকে আরও বেশি হতাশ করে। কারণ দ্বিতীয় সংশোধনী অধ্যাদেশটিও সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুসারে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা অধস্তন কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা কোনো ব্যক্তি বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত হবেন না। কিন্তু অধ্যাদেশের উপধারা (৩) অনুযায়ী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অভিযোগ গঠন করতে পারবেন এবং উপধারা (৯) অনুযায়ী ওই অভিযোগ গঠনকারী ব্যক্তি দণ্ড আরোপ করতে পারবেন। ক্ষমতাপ্রাপ্ত অভিযোগ গঠনকারী ব্যক্তি নিয়োগকারী অপেক্ষা অধস্তন। এজন্য তার দ্বারা দণ্ড আরোপের সিদ্ধান্ত প্রদান সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১)-এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল বলে গণ্য হবে। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের রহিতকৃত অধ্যাদেশ অনুযায়ী কেবল নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষেরই দণ্ড আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল-যেজন্য ওই অধ্যাদেশটি সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১)-এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় কার্যকর ছিল।
১৯৭৬ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিতে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর সুযোগ না থাকায় সরকার একজন কর্মচারীকে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে এ নিয়ে আইনগত জটিলতা দেখা দিলে আইন মন্ত্রণালয় অভিমত ব্যক্ত করে যে, বাধ্যতামূলক অবসর চাকরি থেকে অপসারণ দণ্ডের শামিল এবং এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (২) অনুযায়ী সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। আইন মন্ত্রণালয়ের এ অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের শৃঙ্খলা আপিল বিধি সংশোধন করা হয় এবং পরবর্তী সব শৃঙ্খলাসংক্রান্ত আইন ও বিধিতে গুরুদণ্ড আরোপের ক্ষেত্রে তদন্তের পর দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর বিধান রাখা হয়। রহিতকৃত ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানেও দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু এই অধ্যাদেশে তদন্তের পর দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর সুযোগ রাখা হয়নি। উপধারা (৯) অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর দণ্ড আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক তদন্ত প্রতিবেদনের কপিসহ অভিযুক্তকে অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে, যেজন্য তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বা মতামতের ওপর অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকল না। এছাড়া দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর সুযোগ না রাখার কারণে প্রথম কারণ দর্শানো নোটিশে সুনির্দিষ্টভাবে একটি দণ্ডের প্রস্তাব করতে হবে এবং ওই দণ্ডই আরোপ করতে হবে। প্রস্তাবিত দণ্ড পরিবর্তন করা হলে পরিবর্তিত দণ্ড বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না পাওয়ার প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু অভিযোগ গঠনের সময় অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব না হওয়ায় একটি দণ্ডের প্রস্তাব করা প্রায় অসম্ভব। অধ্যাদেশটিতে তদন্তের পর দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর সুযোগ না রাখায় আরোপিত দণ্ড সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (২)-এর বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বাতিল বলে গণ্য হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সরকারি চাকরি
- আইন সংশোধন