জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির ক্ষতি বিবেচনায় নিতে হবে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বা তদারকিতে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে। এ সংবাদের শিরোনাম হলো, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাচ্ছে কলেজের উচ্চশিক্ষা। বর্তমানে ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজ ছাড়া সব সরকারি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মোট কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ২৫৭। এর মধ্যে সরকারি কলেজ ৫৫৫টি। ঢাকার বড় ৭টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় ২০১৭ সালে। এর আগে এ কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়া ঢাকার বড় ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলে প্রশাসনিক এবং পরীক্ষাসংক্রান্ত নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। এসব কলেজের ছাত্ররা নানারকম সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন অতিরিক্ত দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ২০১৭ সালের পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। এ মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার বড় ৭টি কলেজ পরিচালনায় অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। তবে এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ ২ হাজার ২৫৭টি। এর মধ্যে সরকারি কলেজ ৫৫৫টি। এ ৫৫৫টি সরকারি কলেজ ঢাকা কলেজ কিংবা রাজশাহী কলেজের মতো পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কলেজ নয়। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারীকরণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে এ সরকারি কলেজগুলোও অবকাঠামোগতভাবে অন্য অনেক সরকারি কলেজের মতো উন্নত নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩১ লাখ ৭০ হাজার ৪০১। এর মধ্যে ছাত্রের সংখ্যা ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ১৯২। ছাত্রীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৮২ হাজার ২০৯। দেখা যাচ্ছে, কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যার পার্থক্য মাত্র ৬ হাজারের মতো। এ থেকে বোঝা যায়, দেশের নারী সমাজও উচ্চশিক্ষা লাভে আগ্রহী। সমাজে বড় রকমের একটা পরিবর্তন এসেছে, তা এ পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায়। উচ্চশিক্ষায় নারীদের এ প্রবল উপস্থিতি সমাজে নানা মাত্রিক পরিবর্তনের দ্বার খুলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের টার্শিয়ারি পর্যায়ে শিক্ষার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত কলেজগুলোর একাডেমিক মান সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নত করা সম্ভব হলে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বিপ্লব ঘটে যাবে। সমস্যা হলো, এর জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের ঘাটতি রয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনৈতিক সম্পদের দিক থেকে দেশের সর্বাপেক্ষা সচ্ছল বিশ্ববিদ্যালয়। এর অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের যে ফি ও অন্যান্য প্রদেয় আদায় হয়, তার অঙ্ক বিশাল, এ কারণে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রীয় রাজস্ব সংকটের সময় সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থসম্পদে উদ্বৃত্ত একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ আদায় করে নিয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই। এ সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশের টার্শিয়ারি পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ অর্থসম্পদ দিয়ে অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করা, গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরির মান উন্নত করা সম্ভব। এছাড়া ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে প্রশাসন ও একাডেমিক কার্যক্রমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করাও সম্ভব। দেখা যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবয়ব বহু সমস্যার জন্ম দিয়েছে এবং সে কারণে মনে করা হচ্ছে মাথা কেটেই মাথাব্যথার সমাধান করতে হবে। ব্যাপারটি কিন্তু সেরকম কিছু নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সম্পদের সুষ্ঠু ও উৎপাদনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বর্তমানে পরিলক্ষিত অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারি ও প্রাইভেট কলেজগুলো ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এখনকার সময়ের মতো এত বিশালসংখ্যক ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজ ছিল না। এতৎসত্ত্বেও এ ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষাবিদরা মনে করলেন, একটি এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে, যার দায়িত্ব হবে ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজগুলোর অধিভুক্তি, কোর্স কারিকুলাম নির্ধারণ, শিক্ষক নিয়োগ ও পরীক্ষা গ্রহণসহ নানাবিধ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ। এ ধারণাকেই ভিত্তি করে ১৯৯২ সালে চালু করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনে একদিকে যেমন অধিভুক্ত কলেজগুলোর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দেওয়া আছে, তার পাশাপাশি প্রাগ্রসর শিক্ষা তথা অ্যাডভান্স লার্নিংয়ের নির্দেশনাও দেওয়া আছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময়ে যারা পরিচালনা করেছেন, তাদের সঠিক দূরদৃষ্টি বা ভিশন ছিল না বলে প্রাগ্রসর শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। প্রাগ্রসর শিক্ষার এ অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হলে কলেজ পর্যায়ে বহু শিক্ষককে উচ্চতর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনে প্রণোদিত করা সম্ভব হতো। এছাড়া প্রশিক্ষণ ও একাডেমিক উন্নয়নের অন্যান্য কর্মসূচি তো রয়েছেই। যেমন জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি এবং বিষয় বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন কলেজে প্রেরণ করে অধীত বিষয়ের ওপর বিশেষ বক্তৃতার আয়োজন করা সম্ভব হলে লেখাপড়ার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের সাড়া পড়ে যেত। রেনেদুম্যোঁ নামে একজন ফরাসি কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে কী করতে হবে তার ওপর একটি প্রতিবেদন রচনা করেছিলেন। তিনি ওই প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, কত কাজ করার আছে, কত লোক বেকার আছে! রেনেদুমে্যাঁর ভাষা ধার করে বলা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কত কিছু করতে পারত, কিন্তু উদ্যোগ না থাকায় করা হলো না। এর বিপরীতে বদনামের ভাগীদার হলো। বাংলাদেশের কৃষিতে ড. আক্তার হামিদ খানের মতো ভিশনারি ব্যক্তিত্ব যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন, তার মতো একজন লোক পেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের টার্শিয়ারি শিক্ষার ক্ষেত্রে রেনেসাঁ ঘটিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো। সংকীর্ণ রাজনৈতিক অভিলাষ, নতুন ধরনের চিন্তাভাবনার অভাব, উচ্চাভিলাষ, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সমস্যার সমাধানের উপায় না ভেবে সমস্যার উৎসে পরিণত করেছে।