বই, গাছের চারা হোক সেরা উপহার
বই আর বৃক্ষের মধ্যে একটি বৈরী সম্পর্ক আছে। বই ছাপতে যে কাগজ লাগে, সেই কাগজ তৈরি করতে প্রতিবছর লাখো-কোটি বৃক্ষের বিনাশ ঘটে। বৃক্ষের কাঠ থেকে মণ্ড তৈরি করে তা থেকে হয় কাগজ। বইমেলার ঠিক আগে একদিন অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন বলছিলেন, ‘বিষয়টা আগে কখনো এভাবে চিন্তা করিনি। এখন বিদেশি একজনের কাছ থেকে কথাটা শোনার পর মনের মধ্যে একটা পাপবোধ বাসা বেঁধেছে। আমরা প্রকাশকেরা কি তাহলে জ্ঞান ও সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে প্রকৃতির বিনাশ ঘটাচ্ছি? সেই মর্মপীড়া থেকে কয়েকজন প্রকাশক সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা যে ক্ষতির কারণ হচ্ছি, সেই ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণ করব, দেশজুড়ে বৃক্ষ রোপণের একটা কার্যক্রম গ্রহণ করব। আর তার শুভসূচনা করব এবারের বইমেলা থেকেই।’
এ আশায় তিনি এসেছিলেন বইমেলা শুরুর কয়েক দিন আগে বাংলা একাডেমিতে, নিসর্গী মোকারম হোসেন ও আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে। তাঁকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখে ভালো লাগল। ভাবলাম, এভাবে সবাই ভাবলে তো দেশটা গাছে গাছে ভরে যেত। স্বাগত জানালাম তাঁদের এই শুভচিন্তাকে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসটা গাছ লাগানোর জন্য খুব উপযুক্ত নয় বিধায় তাঁকে দুজন মিলে নিরস্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। বললেন, ‘গাছ আমরা বর্ষার আগেই লাগাব, তবে এ সময় বইয়ের মাসে সেই কাজের শুভসূচনা হোক।’ শেষে সিদ্ধান্ত হলো, ব্যবস্থা করতে পারলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি কনকচাঁপা ও একটি দুলিচাঁপাগাছ লাগিয়ে সেই কার্যক্রম শুরু করা হবে। পরে ঢাকা শহরের যেখানে যতটুকু গাছ লাগানোর সুযোগ আছে, সেখানে প্রকাশকেরা দল বেঁধে নিয়ম মেনেই গাছ লাগাবেন। প্রকাশক সাহেবের কথাগুলো আমাদের আলোড়িত করল। সত্যিই তো, এভাবে যদি বিভিন্ন পেশাজীবী এগিয়ে আসেন, দেশের মানুষকে যদি সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে তো দ্রুতই দেশটা সবুজে শ্যামলে ভরে দেওয়া সম্ভব।
এ রকম বেশ কিছু উদ্যোগ এর আগেও অনেকে নিয়েছিলেন। টাঙ্গাইলে মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া তাঁর ইউনিয়নের কোথাও কোনো শিশু জন্ম নিলে খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে ছুটে যেতেন। নিজে নবজাতকের বাড়িতে দুটি করে গাছের চারা রোপণ করতেন আর সেই নবজাতকের বাবা-মাকে গাছ দুটির পরিচর্যা করার অনুরোধ করে আসতেন। শিশুটির সঙ্গে গাছ দুটিও বড় হবে, একটি মরলেও আরেকটি অন্তত টিকবে। সেই গাছই হবে এ দেশের পরিবেশ ও শিশুটির জন্য জীবনবিমা। কোনো কোনো উপজেলায় পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের বই ও গাছের চারা উপহার দেওয়া হয়। ছোটবেলায় দেখেছি, বিয়েবাড়ি বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বিশেষ করে উপন্যাস ও গল্পের বই। নববধূরা সেই সব উপহারের বই পেয়ে আনন্দিত হতেন, পড়তেন মনের খুশিতে। এখনো কেউ কেউ হয়তো আরও অনেক উদ্যোগ নেন, যার সব আমরা জানি না। এগুলো আমাদের জন্য অবশ্যই প্রেরণাদায়ক।
এ রকম এক অসাধারণ প্রেরণা জুগিয়েছিল ২০১৯ সালে তুরস্কের আনিস সাহিনের একটি ফেসবুক পোস্ট। সেই পোস্টে তিনি লিখেছিলেন: ‘দুর্দান্ত একটি আইডিয়া পেয়েছি। মুসলিম দেশ হিসেবে আমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় সরকারি ছুটি পাই। বৃক্ষরোপণের জন্য একটি সরকারি ছুটি হলে কেমন হয়? আসুন দেশের ৮ কোটি ২০ লাখ মানুষ একসঙ্গে ওই দিনটিতে গাছ লাগাই। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে চাই।’ আনিস সাহিনের সেই পোস্ট ভাইরাল হয়ে পড়লে একপর্যায়ে তা তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নজরেও পড়ে। তিনি লেখেন, ‘চমৎকার একটি আইডিয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। শিগগিরই আমি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে বৃক্ষরোপণের জন্য একটি ছুটির দিন ঘোষণা করব।’ পরে তিনি সেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রতিবছর ১১ নভেম্বরকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করেন তিনি এবং ওই দিনে দেশজুড়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালনের ব্যবস্থা করেন। প্রথম বছরেই ওই দিনে তুরস্কের সবাই মিলে ১ কোটি ৩০ লাখ গাছের চারা লাগিয়েছিলেন। এমন দৃষ্টান্ত কি আমাদের দেশেও অনুসরণীয় হতে পারে না?
প্রতিবছর বইমেলা এলে লাখ লাখ বই ছাপা হয়। বই জ্ঞানচর্চা ও সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশের হাতিয়ার। সেই বই যদি কেউ না পড়ে, তাহলে আর তা লিখে ও প্রকাশ করে লাভ কী? বর্তমান বই-সংস্কৃতি ও পাঠাভ্যাস নিয়ে লেখক-প্রকাশকেরা শঙ্কিত, শেষে কি প্রকাশনা ব্যবসার ইতি টানতে হয়! এ অবস্থা প্রকট হওয়ার আগেই বইয়ের প্রতি, পাঠের প্রতি মানুষকে বেশি করে আগ্রহী করা দরকার। বই উপহার ভালো উপায়। বই ছাপতে কাগজ লাগে। কাগজ তৈরির উপকরণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাঠের মণ্ড ও রাসায়নিক দ্রব্য। তা তৈরি করতে একদিকে বনজ বৃক্ষ উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে মণ্ড ও রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করতে কারখানা চালাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, বৃক্ষ নিধনের ফলে সেই সব দূষণ হ্রাসের পথও সংকুচিত হচ্ছে।